সংবিধান সংস্কার ও ক্ষমায় শ্রীলঙ্কার শ্রীবৃদ্ধি by মিজানুর রহমান খান

প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ক্ষমা করেছেন তাঁকে
হত্যাচেষ্টাকারী সাবেক তামিল বিদ্রোহীকে
তিন বছর আগে প্রধান বিচারপতি শিরানিকে বিতর্কিত প্রক্রিয়ায় অপসারণ করে যে শ্রীলঙ্কা দুর্নাম কুড়িয়েছিল, সেই শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশীয় হিসেবে তারা নজির সৃষ্টি করেছে যে ব্যক্তির বদল শুধু ক্ষমতার হাতবদল ঘটায় না, ব্যাপকভিত্তিক ও সুদূরপ্রসারী সংবিধান সংস্কারেরও বাস্তবায়ন ঘটে। শিরানিকে অপসারণকারী প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে গত বছরের জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হন। তাঁর পরিবর্তে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ঝানু রাজনীতিক মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। জেনারেল এরশাদ প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দীন হোসেনকে রাজাপক্ষের স্টাইলেই অপসারণ করেছিলেন। কিন্তু কলম্বো যে ইতিহাস সৃষ্টি করল, ঢাকা তা আজও করেনি।
এরশাদের পতনের পরে উচিত ছিল বিচারপতি মুনিমের নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করা, একই যুক্তিতে আমরা কিন্তু জিয়া-এরশাদকে অবৈধ বলি। শিরানিকে সরানোর পরে রাজাপক্ষের মুনিম হয়েছিলেন মোহন। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা মোহনকে অবৈধ বিবেচনায় শিরানিকে প্রধান বিচারপতি পদে পুনর্বহাল করেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পরদিনই (২৯ জানুয়ারি ২০১৫) তিনি পদত্যাগ করলে নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে আসেন কে. শ্রীপবন। গত এক বছরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে এমন অনেক কিছু গুণগত পরিবর্তন এসেছে, যা অবশিষ্ট বিশ্ব আগ্রহভরে লক্ষ করছে।
শ্রীলঙ্কা থেকে পাওয়া তিনটি খবর আমাদের আকৃষ্ট করেছে। প্রথমত, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা তাঁকে হত্যাচেষ্টার দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিকে ক্ষমা করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি স্বীকারও করেছেন যে এক ব্যক্তির হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। তৃতীয়ত, জাতিসংঘ দাবি করেছে যে শ্রীলঙ্কাকে গৃহযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
আমরা আশাবাদী হয়ে লক্ষ করছি যে, একসময়ের অন্যতম গোলযোগপূর্ণ আমাদের এই কাছের দেশটিতে নেতার গুণে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। এ সপ্তাহে সিরিসেনা আবারও বলেছেন, তিনি এ বছরেই সংসদকে গণপরিষদে রূপান্তর করবেন। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করবেন। এর মোড়কে ছদ্মবেশী রাষ্ট্রপতি শাসনটা তিনি ধরে রাখবেন না। তাঁর এই মনোভাব আমাদের এরশাদের পতনের পরে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সংসদীয় ব্যবস্থা’ প্রবর্তনের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে সংবিধান সংস্কার মুখ্য ইস্যু ছিল না। ছিল এরশাদের পতন। তদুপরি সংস্কারের নামে নামসর্বস্ব সংসদীয় গণতন্ত্র আনা হলো। রাষ্ট্রপতি শব্দ মুছে প্রধানমন্ত্রী লিখে মানুষকে নতুন করে বিভ্রান্ত করা হলো। কারণ, ‘সংসদীয় ব্যবস্থার’ নামে সামরিক জামানায় বিকশিত হওয়া রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিটাই রেখে দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে আমরা দেখি, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সাইনবোর্ড মুছে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় লেখা হয়েছে।
সিরিসেনার দেশটিতে দাবি উঠেছে, এমন করে একটি নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে, যাতে সেটা গৃহযুদ্ধের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারে। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়েই সংখ্যালঘু তামিলদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ২৬ বছর মেয়াদি একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটেছিল। কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, সেটা হলো সিরিসেনা ভেবেচিন্তে এমন সব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন, যার সঙ্গে গান্ধীজি, ম্যান্ডেলা ও অং সান সু চির অনুসৃত পথ এবং নীতি-আদর্শের মিল রয়েছে। ৩৬ বছর বয়সী সাবেক তামিল টাইগার শিবরাজ জেনিভান ১০ বছর ডিটেনশনে থেকে গত বছরে সিরিসেনাকে হত্যাচেষ্টার দায়ে ১০ বছর সাজাপ্রাপ্ত হন। ৯ জানুয়ারি সিরিসেনা সরকারের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মঞ্চে দণ্ডিতের সঙ্গে প্রেসিডেন্টকে করমর্দনরত দেখা গেছে। শিবরাজ সিরিসেনাকে অভিনন্দন জানান। এটা আশার কথা যে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমা করার মতো ঔদার্য প্রশংসনীয়ভাবে জায়গা করে নিচ্ছে।
আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, নেপালের মতোই এই দ্বীপরাষ্ট্রের সংবিধানে জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমান মর্যাদা প্রদানের দাবি উঠেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা তামিলদের জীবনের কিছু ক্ষেত্রে বাঙালির জীবনের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী হয়ে উঠেছিল। পাঞ্জাবিরা ফেডারেল কাঠামো মানতে চায়নি। কারণ, তাহলে বাঙালিদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়। সিংহলিরাও ফেডারেল নয়, ইউনিটারি বা এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়েছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটি বর্তমানে মূলত ১৯৭৮ সালের সংবিধান দিয়ে চলছে। বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্র বা সরকারি ধর্ম ঘোষণা না করে তারা শুধু বলেছে, বৌদ্ধধর্ম অগ্রগণ্য হবে। আবার এটাও ঠিক যে ভারত, নেপালসহ বিশ্বের অন্য বহু দেশের মতো সংবিধানেই তারা বিরোধী দলের নেতাকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানের প্রবণতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশে এমন দাবি এখনো জনপ্রিয় নয় যে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের মতামত থাকা বা তার সঙ্গে পরামর্শ থাকাটা গণতন্ত্রের দাবি।
শ্রীলঙ্কায় একটি নতুন সাংবিধানিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনসহ সব ধরনের কমিশনের নিয়োগ হবে এই পরিষদের সুপারিশে। প্রতি তিন মাসে একটি সভা হবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের পরেই বিরোধী দলের নেতাকে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা মিলে পাঁচজনকে (নির্দলীয় নিরপেক্ষ হবেন তিনজন) মনোনয়ন দেবেন। ছোট দল ও স্বতন্ত্র এমপিদের কণ্ঠস্বরকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কারণ, তারাও ওই পরিষদে একজনকে মনোনয়ন দিতে পারবেন। সংবিধানই বলছে, এর উদ্দেশ্য সমাজের বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ লালন ও পরিচর্যা করা। নেপালের নতুন সংবিধানেও এমন বিধান আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তুলনা করতে পারি, এমন কোনো রক্ষাকবচ আমাদের সংবিধানে নেই।
আমরা এর আগে নেলসন ম্যান্ডেলার রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া আগ্রহভরে লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু তা থেকে কতটা শিখেছি কিংবা শিখতে চাইছি, সেই প্রশ্নে নানা মত ও পথ থাকবে, কিন্তু এবারে আমরা আরও ঘরের কাছে সংঘাত–পরবর্তী আপস ও সমঝোতার প্রক্রিয়া দেখতে পারব। বেহাত হওয়া ভূমি তার মূল মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। আমরা অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়ন করতে পারি না। দেখি সংসদীয় কমিটির অরণ্যে রোদন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি কমিশন কাগুজে কমিশন রয়ে গেছে। আর সিরিসেনা বলছেন, তিনি জাতিগত হানাহানিতে লিপ্ত থাকা জাতির ঐক্য স্থাপন করবেন। সবচেয়ে বড় বাধা ভূমি সমস্যা নিরসন করা।
গত মাসে সিরিসেনা গৃহযুদ্ধে সব থেকে ক্ষতবিক্ষত উত্তরাঞ্চলীয় শহর জাফনা সফর করেন। তিনি দেখেন, একটি উদ্বাস্তু শিবিরে ২৫ বছর ধরে প্রায় ১ হাজার ৩০০ পরিবার বাস করেছিল। গোলযোগপূর্ণ এলাকার বেসরকারি জমি সামরিক বাহিনীর দখলে চলে গেছে। সিরিসেনা বলেছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব জমিতে পুনর্বাসন শুরু হবে। এ মাসেই তিনি জাফনায় প্রায় ৭০০ একর জমি হস্তান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন। এক লাখ যুদ্ধ–ভুক্তভোগীকে ভূমি দেওয়া ছিল তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার। এটা সুখকর যে তিনি সাবেক বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি বিশ্বাসযোগ্য শান্তিচুক্তি করেছেন। আশা করব, তিনি দক্ষিণ এশীয় কোনো কোনো নেতার মতো জমি ফিরিয়ে দেওয়ার চুক্তি ভঙ্গ করবেন না। সংখ্যালঘু তামিল ও মুসলমানদের সমর্থনে সিরিসেনা গত বছরের জানুয়ারিতে নির্বাচিত হন।
সিরিসেনা কী করে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও রিকনসিলিয়েশন করেন, সেটা দেখার বিষয়। ২৫ বছরের নয়, ‘চূড়ান্ত পর্বের’ যুদ্ধাপরাধকে বিবেচনায় নেওয়া হবে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এটা ‘ইনস্ট্যান্ট নুডলস’ নয়। তাঁর কথায়, ‘আমরা জবাবদিহি প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কোনো তাড়াহুড়ো করতে পারি না। আমাদের দায়িত্বশীল এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।’ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সিরিসেনা সরকারি সৈন্য ও তামিল বিদ্রোহীদের দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের তদন্তের আশ্বাস দিচ্ছেন।
সিরিসেনার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির কিছু অভিযোগ উঠেছে। কারণ, তাঁর ভাই ও জামাতাকে টেলিকম ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়েছেন। প্রটোকলের ছন্দপতন ঘটিয়ে মেয়েকে বিদেশে সরকারি প্রতিনিধিদলে ঠাঁই দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। তাই দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি বিবেচনায় নিলে এটুকু খুব দোষের নয়, যদিও না হলেই ভালো হতো। তবে তিনি গত এক বছরে অনেক বড় মাপের কাজ করেছেন। ক্ষমতা গ্রহণের চার মাসের মধ্যে সংবিধানের ১৯তম বিল পাস করে তিনি বিস্ময়করভাবে ক্ষমতার প্রতি নির্মোহ মনোভাবের বিরল বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
সংবিধানে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ছিল ছয় বছরের। এটা এক বছর কমিয়েছেন, বিধান করেছেন দুবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট হবেন না। আর নিজে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হবেন না। গত এপ্রিলে ১৯তম সংশোধনী পাস হয়। তবে এর বৈধতা বিল পাসের পরে নয়, সুপ্রিম কোর্ট বিল পাসের আগেই পরীক্ষা করেছেন। প্রধান বিচারপতি শ্রীপবনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ বলেছেন, প্রস্তাবিত সব সংশোধনী সাংবিধানিক।
তবে কতিপয় বিধানের জন্য গণভোট লাগবে। এর মধ্যে রয়েছে এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্সির বিলুপ্তি। আগে মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী থাকলেও তার প্রধান ছিলেন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট সেখান থেকে সরে যাবেন। যদিও সুপ্রিম কোর্টের ১৮ পৃষ্ঠার রায় পড়ে মনে হলো বিচারকেরা ব্যক্তির হাতে লেপটে থাকা নির্বাহী ক্ষমতাকে হুমকি মনে করছেন না। তাঁরা বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নির্বাহী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আইন প্রণয়ন ক্ষমতাকে চিহ্নিত ও “পার্সোনালাইজড” করা ঠিক হবে না। সব সময় মনে রাখতে হবে এই ক্ষমতার উৎস জনগণ।’ আমাদের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়েও প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা নির্বাহী ক্ষমতাকে (এক্সিকিউটিভ প্রাইম মিনিস্ট্রি) এভাবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সিরিসেনার অবস্থানই সমর্থনযোগ্য। প্রধান নির্বাহী ও রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পরামর্শে তিনি তা প্রয়োগ করবেন। এবারে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা আরও কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। নিজেকে তিনি রাবার স্ট্যাম্প করেননি।
১৯তম সংশোধনী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে ইসির সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতিকেই বিশেষ ভূমিকা পালনের ম্যান্ডেট দিয়েছে। আমরা লক্ষ করব, এই কাজটা করতে সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করতে বলেনি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.