নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে চাই সমষ্টিগত পদক্ষেপ

১৬ দিনব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী কর্মতৎপরতা প্রচার উপলক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত নয়জন নারী রাষ্ট্রদূত এক যৌথ নিবন্ধে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নিবন্ধটি লিখেছেন পেমা শোডেন (রাষ্ট্রদূত, ভুটান); ওয়ানজা ক্যাম্পোস দ্য নব্রেগা (রাষ্ট্রদূত, ব্রাজিল); হ্যান ফুগল এস্কেয়ার (রাষ্ট্রদূত, ডেনমার্ক); সোফি অবেয়ার (রাষ্ট্রদূত, ফ্রান্স); নোরলিন বিন্তি ওসমান (রাষ্ট্রদূত, মালয়েশিয়া); লিওনি মার্গারিটা কুয়েলেনায়ের (রাষ্ট্রদূত, নেদারল্যান্ডস); মেরেটে লুন্ডিমো (রাষ্ট্রদূত, নরওয়ে); ইয়াসোজা গুনাসেকেরা (রাষ্ট্রদূত, শ্রীলঙ্কা) ও মার্শা বার্নিকাট (রাষ্ট্রদূত, যুক্তরাষ্ট্র)
নয়টি জাতির প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশে নিযুক্ত নয় জাতির নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমরা অবশ্যই অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করছি। তবু আমরা এ ব্যাপারে একমত যে সারা বিশ্বে, আমাদের দেশে এবং বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সাড়া দেওয়া ও এর প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা জরুরি ভিত্তিতে আমলে নেওয়া উচিত।
গবেষণায় দেখা গেছে যে নারীর প্রতি সহিংসতা (জেন্ডার-বেজড ভায়োলেন্স-জিবিভি) ভয়ানক আকারে সারা বিশ্বে বিস্তৃত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনজনের একজন নারী তাঁর জীবনে সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী তাঁদের স্বামীর হাতে নিগৃহীত হন।
পেমা শোডেন, ওয়ানজা ক্যাম্পোস দ্য নব্রেগা, হ্যান ফুগল এস্কেয়ার
আমরা সবাই এর প্রতিরোধে কিছু করতে পারি। নারীর প্রতি সহিংসতা সমস্ত সম্প্রদায়ের ওপর হুমকিস্বরূপ, এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস করে এবং সহিংসতা ও দ্বন্দ্বকে উসকে দেয়। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, নারীর ওপর সহিংসতার উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়, নারীদের আয়ের উৎস হারানো, উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং বংশপরম্পরায় নেতিবাচক প্রভাব।
‘ইউএন উইমেন’ অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়স পর্যন্ত নারী ও মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে সমষ্টিগতভাবে ক্যানসার, সড়ক দুর্ঘটনা, ম্যালেরিয়া এবং যুদ্ধের কারণে মৃত্যুর চেয়েও নারীর প্রতি সহিংসতা অধিকতর মৃত্যু ও শারীরিক অক্ষমতার কারণ।
জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে সহিংসতার শিকার হওয়া থেকে শুরু করে যৌন হয়রানি এবং জোর করে বিয়েসহ নারীর প্রতি সহিংসতার বহু ধরন রয়েছে। সহিংসতা যে রকমই হোক, তা আমাদের সামগ্রিক মানবতার জন্য কলঙ্ক, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বাধা এবং তা আমাদের এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়। সহিংসতা অত্যাবশ্যকীয় নয় এবং আমরা প্রত্যেকেই এটি বন্ধের জন্য কাজ করতে পারি।
সোফি অবেয়ার, নোরলিন বিন্তি ওসমান, লিওনি মার্গারিটা কুয়েলেনায়ের
‘নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের কর্মতৎপরতা’ সবার জন্য এ ব্যাপারে কাজ করার একটি সুযোগ। প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ দিবসে ১৬ দিনের কর্মতৎপরতা শুরু হয়, যেটি ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে শেষ হয়। জাতিসংঘের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই প্রচারাভিযানে নারী ও পুরুষ, ছেলে ও মেয়ে, সরকারি কর্মকর্তা, কমিউনিটি নেতাসহ সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পুরো পৃথিবী এবং বাংলাদেশজুড়ে নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী সচেতনতা ও প্রথা তৈরিতে মানুষ কাজ করছে, যা এই অভিশাপ থেকে মুক্তির পূর্বশর্ত।
বৈশ্বিক পর্যায়ে আমরা যে দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করি—ভুটান, ব্রাজিল, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, শ্রীলঙ্কা ও যুক্তরাষ্ট্র—এই দেশগুলো নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নতুন ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করছে। নতুন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পরস্পর সম্পর্কিত লিঙ্গসমতা এবং নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়নে জোর দেয়। এ বিষয়ে আমাদের অবশ্যই দৃষ্টিপাত করতে হবে যদি আমরা উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করতে চাই। এখন বাস্তবায়নের প্রতি আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। এ প্রচেষ্টায় অন্যান্য সরকার, বেসরকারি খাত এবং বিশেষ করে সুশীল সমাজের সঙ্গে অংশীদারত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নারীর প্রতি সহিংসতা রুখতে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের জীবনে পদক্ষেপ নিতে পারি। ভুক্তভোগীদের কথা শুনে ও বিশ্বাস করে আমরা তাদের সহায়তা করতে পারি। পুরুষ ও ছেলেদের শেখাতে পারি যেন তারা নারী ও মেয়েদের সহযোগিতা করে এবং তাদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
মেরেটে লুন্ডিমো, ইয়াসোজা গুনাসেকেরা, মার্শা বার্নিকাট
দেশে ও বিদেশে আমাদের সরকারগুলো নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রকল্পে সহায়তা প্রদান করে নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে শিক্ষা দেয়, যেন আইনি সহায়তা বাড়ানো যায়; সেবাদানকারীদের প্রশিক্ষণ দেয়, যেন তারা ভুক্তভোগীদের প্রয়োজনীয়তাগুলো ভালোভাবে চিহ্নিত করতে পারে এবং বিচার ও জবাবদিহি বৃদ্ধি করতে পারে। আমরা সেই সব প্রকল্পে অনুদান দিই, যেসব প্রকল্প ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও কারিগরি শিক্ষা প্রদান করে। এবং ধর্মীয়, ব্যবসায়িক ও সামাজিক নেতাদের সঙ্গে কাজ করি, যেন নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা বন্ধ করা যায়।
আমরা এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত হয়েছি, কারণ আরও একটি বিষয়ে আমরা সবাই একমত যে শুধু সমষ্টিগত পদক্ষেপের মাধ্যমেই নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব।
৮ ডিসেম্বর, ২০১৫

No comments

Powered by Blogger.