স্বামীর বর্বরতায় আলো নিভে গেল শিউলির by রোকনুজ্জামান পিয়াস

আমার কী দুই চোখই নেই? শিউলির এমন প্রশ্নে আঁতকে ওঠেন নার্স নাজমা সুলতানা। থমকে যান তিনি। তাহলে কী শিউলি এখনও জানেন না তার ওপর চালানো স্বামীর পৈশাচিকতার ভয়াবহতা? শিউলির ধারণা, তার চোখের ব্যান্ডেজ খুলে দিলেই হয়তো তিনি আবার আগের মতো দেখতে পাবেন। এই সময়টার চিকিৎসা ব্যয় নিয়েও চিন্তিত তিনি। আসলে শিউলি তার চোখের আলো ফিরে পাবেন না- এটা তিনি জানেন না। এ ব্যাপারে সন্দিহান চিকিৎসকরাও। চিকিৎসকদের ধারণা, আজ অপারেশনের পর কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যাবে। এর মধ্যে যতটুকু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তাতে ফলাফল হতাশাজনকই। স্বামী জুয়েল হাসান ধারালো চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার দু-চোখ তুলে ফেলেছে। ভেতরে আর তেমন কিছুই নেই। চোখের পাতাও এবড়োথেবড়োভাবে ছিড়ে ফেলেছে। গতকাল রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের কমিউনিটি ইউনিটে ৬নং বেডে চিকিৎ?সাধীন শিউলি আক্তারের দুই চোখে ব্যান্ডেজ। পাশ দিয়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এ অবস্থা দেখেই যে কেউ বলে দিতে পারবে কি ধরনের বর্বরতার শিকার হয়েছেন তিনি। ঘটনার পর এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে শিউলিকে এ হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়। এর আগে ৫০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। রোগীর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকেই এই হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
বৃহস্পতিবার বিকালে টঙ্গীর পাগাড় মধ্যপাড়া এলাকার ভাড়া বাসায় স্বামী জুয়েল স্ত্রী শিউলি আক্তারকে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চোখ তুলে ঘরের ভেতরে রেখেই বাসা তালাবদ্ধ করে চলে যান। চিৎকার শুনে পরে প্রতিবেশীরা পুলিশের সহায়তায় ঘরের তালা ভেঙে শিউলিকে উদ্ধার করেন। গৃহবধূ শিউলি বলেন, তার বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার দলিরহাট গ্রামে। এটি তার দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম স্বামী আনোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর তিনি পাঁচ বছর আগে দ্বিতীয়বার জুয়েলের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ বিয়ের পর থেকেই তিনি দেখছেন স্বামী জুয়েল নেশাগ্রস্ত। তিনি সব সময়ই নেশা করে বাড়ি ফেরেন। বাড়ি ফিরে প্রায়ই স্ত্রীকে মারধর করে। এছাড়া আগের স্বামীর কাছ থেকে যে সম্পত্তি পাবেন, তা এনে দেয়ার জন্যও তাকে মারধর করতো জুয়েল। আর নেশার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তার চরিত্র নিয়েও সন্দেহ করতো। তাছাড়া জুয়েল কোন কাজ করে না। তার বোনের জায়গা বিক্রি করা টাকা নিয়ে চলতো।
শিউলি বলেন, ‘অন্যান্য দিনের মতো বৃহস্পতিবার বিকালেও সে নেশা করে বাড়ি ফেরে। ইয়াবা না কি যেন খেয়ে আসে। ঘরে ঢুকেই আমাকে সন্দেহ করতে থাকে। বলে, ঘরে কে আসছিলো বল। কেউ আসেনি বললে সে বিশ্বাস না করে মারধর করতে থাকে। পরে বলে কবে জায়গা বিক্রি করবি? একপর্যায়ে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আমাকে বলে, যা যা বলবো সত্যি বলবি। কিন্তু সে আমার কোন কথায়ই কান দেয় না। মারধর করতে থাকে। একপর্যায়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখে স্কচটেপ লাগাইয়া দেয়। আমার দুই হাত পিঠমোড়া দিয়ে বাইন্ধ্যা ফেলে। দুই পা বান্ধে। এক সময় চাকুর শব্দ পাই। চোখে কী করলো জানি না। জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখি হাত খোলা। চারদিকে অন্ধকার। চোখে কিছু দেখতে পারি না। মুখ থেইক্যা স্কচটেপ টাইন্যা একটু খুইল্যা টুকাতে টুকাতে জানালার ধারে গিয়া চিৎকার দিই। পরে আর কিছু মনে নাই।’ প্রতিবেশীরা গিয়ে দেখেন বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে জুয়েল পালিয়ে গেছে। পরে তারা পুলিশের সহযোগিতায় শিউলিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
গতকাল সন্ধ্যায় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের নার্স নাজমা সুলতানা জানান, তার দুই চোখের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে মানুষ এত বর্বর হাতে পারে! তার সারা শরীর রক্তমাখা। ভেতরের কাপড়-চোপড়ও রক্তে ভিজে গেছে। পরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে গোসল করানো হয়েছে। মানুষ এমনভাবে চোখে আঘাত করে এমন কথা বলতেই শিউলি বলেন, আমার কী দুটো চোখই নেই। তখন আমি আঁতকে উঠি। ভাবলাম তিনি হয়তো এখনও জানেন না। তাকে বলেছি, আমি তো আপনাকে ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় পেয়েছি। ভেতরে কী হয়েছে আমি জানি না।  নাজমা বলেন, তিনি হয়তো মনে করছেন তার চোখ ভালো আছে। হাসপাতালের ইমারজেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ডা. তৌহিদ আনোয়ার বলেন, রাত ১২টা ৫০ মিনিটে শিউলি আক্তার এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে ঘটনার পর প্রথমে তাকে টঙ্গী ৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। তিনি বলেন, ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিউলির চোখ তুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকটা অংশ তুলে ফেলা হয়েছে। দুই চোখের ভেতরে আর কিছু নেই। এখন শুধু চোখের অবয়ব আছে। অবস্থা খুব ভয়াবহ। চোখের পাতাও এবড়োথেবড়োভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। ডা. আনোয়ার বলেন, আমাদের এখানে মেডিক্যাল বোর্ড আছে। যার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক। এই বোর্ডের তত্ত্বাবধানে সবকিছু হচ্ছে। আজ রোগীর অপারেশন হবে। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যে অবস্থা তাতে চোখের আলো ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
শিউলির প্রথম স্বামী মারা যান ২০০৯ সালে। এর এক বছর প্রথম স্বামীর চাচাতো ভাই জুয়েলের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এ বিয়েতে পরিবারের লোকজন রাজি না ছিল না। ফলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় পক্ষে কোন সন্তান না হলেও শিউলির প্রথম পক্ষে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তারা উভয়ে নানার বাড়ি থেকে পড়ালেখা করছে। ছেলে শিবলু একাদশ শ্রেণীতে এবং মেয়ে আঁখি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ালেখা করে। ঘটনা শোনার পরপরই মেয়ে আঁখি বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে গতকাল বিকালে মায়ের কাছে পৌঁছে। আঁখি জানায়, সে মায়ের কাছে মাঝে মাঝে আসতো। তার চাচা (জুয়েল) কখনও কখনও খারাপ, আবার কখনও ভালো ব্যবহারও করতো তার সঙ্গে।

No comments

Powered by Blogger.