‘আক্রান্ত হলেই গুলি’, নিরস্ত্র মানুষ কী করবে? by সোহরাব হাসান

গতকাল শুক্রবারের প্রথম আলো ও ইত্তেফাক-এর দুটি খবর পাশাপাশি রেখে পড়লে কেউ হাসি ধরে রাখতে পারবেন না।
ইত্তেফাক-এর প্রধান শিরোনাম: ‘আক্রান্ত হলেই পাল্টা গুলি’। ভেতরের সারমর্ম হলো, গত বৃহস্পতিবার পুলিশের সব শাখার শীর্ষ কর্মকর্তারা একবাক্যে ঘোষণা দিয়েছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ গুলি করবে। আক্রান্ত হলেই পাল্টা গুলি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, টহল বা চেকপোস্টে পুলিশ গুলিবিদ্ধ হবে, সন্ত্রাসীরা গুলি করে চলে যাবে, পুলিশ গুলি করবে না—এটা হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার্থে তাৎক্ষণিকভাবে গুলি চালাতে হবে। র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবপ্রধান বেনজীর আহমেদও একই কথা বলেছেন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও সারা দেশে কর্মকর্তাদের কাছে পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার বার্তা পাঠানো হয়েছে।
আর প্রথম আলোর খবরটির শিরোনাম ছিল, ‘পুলিশের রাইফেলে গুলি ছিল না’। ভেতরে আছে, ‘আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় কর্তব্যরত পুলিশের পাঁচ সদস্যের কারও রাইফেলেই গুলি ছিল না। তাই হামলার শিকার হওয়ার পর তাঁরা কোনো পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। পুলিশের তিনজন সদস্য তো শালবনের দিকে দৌড়ে পালিয়েই গেছেন।’ গত বুধবার সকালে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় পুলিশের একটি তল্লাশিচৌকিতে হামলা চালায় দুই ব্যক্তি। তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কনস্টেবল মুকুল হোসেন নিহত ও কনস্টেবল নূরে আলম সিদ্দিকী গুরুতর আহত হন।
প্রশ্ন হলো, গুলি যদি রাইফেলে ভরাই না থাকে, তাহলে পুলিশের সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ার পর পাল্টা গুলি করবেন কীভাবে? রাইফেলে গুলি ভরতে ভরতে সন্ত্রাসীরা বীরদর্পে জায়গা ত্যাগ করবে। মিরপুর, আশুলিয়া, শাহবাগ কিংবা লালমাটিয়ার ঘটনায় দেখা গেল, সন্ত্রাসীরা তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি কিংবা আংশিক পূর্ণ করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেছে। কোথাও বাধার মুখোমুখি হয়নি। মিরপুরে সহযোগী পুলিশ সদস্য নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর আশুলিয়ায় তিন সদস্য পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। নির্ভীক পুলিশই বটে!
পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা কিংবা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি দেখে মনে হতে পারে যে, আক্রান্ত হলে আগে পুলিশ গুলি করত না বা এ ক্ষেত্রে আইনি বাধা আছে। পুলিশ প্রবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, কেউ আক্রান্ত হলে পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারবেন। বাংলাদেশের পুলিশ আইনে কোনো সংস্কার হয়নি। সেই ঔপনিবেশিক আইন দিয়েই চলছে।
এ ছাড়া আমরা তো প্রায়ই পত্রিকায় বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টারের গল্প পড়ি। এতে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা সন্দেহভাজনকে ধরল এবং সেই সন্ত্রাসী বা সন্দেহভাজনের জবানবন্দি অনুযায়ী তার সহযোগীদের ধরতে বা আস্তানায় হানা দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তারাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এরপর অনিবার্যভাবে যে ঘটনাটি ঘটে তা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আগে থেকে আটক সন্ত্রাসী বা সন্দেহভাজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়।
আমরা এও জানি যে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নয়, একজন সাধারণ নাগরিকও আক্রান্ত হলে নিজেকে রক্ষার জন্য পাল্টা আঘাত করতে পারে। এবং ওই ব্যক্তি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে আক্রান্ত হওয়ার পরই পাল্টা আঘাত হেনেছেন, তাহলে তাঁর এই আঘাত ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে না।
আশুলিয়ার ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও তৎপরতা দেখে মনে হবে, ‘গুলি ছোড়া না-ছোড়ার’ ওপরই সর্বাংশে তাঁদের ও দেশের মানুষের নিরাপত্তা নির্ভর করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপযুক্ত শিক্ষা, পেশাগত প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা, সততা সর্বোপরি যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে বসানোর কোনো প্রয়োজনই নেই। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের কথা শুনে আসছিলাম। এর জন্য ইউএনডিপির তত্ত্বাবধানে একটি সুপারিশও করা হয়েছিল। ওই পর্যন্ত। কোনো কাজ হয়নি।
দ্বিতীয়ত, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো চলছে ঔপনিবেশিক আমলের আইনে কিন্তু সন্ত্রাসীরা ইতিমধ্যে ব্যবহার করছে অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে অপরাধীরা প্রধানত দেশীয় অস্ত্র তথা রামদা, ভোজালি, ছোরা, চাকু, চাপাতি বড়জোর পিস্তল ব্যবহার করত। এখন তাদের হাতে সব ধরনের আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি এসেছে। এসব অস্ত্রধারীকে মোকাবিলা করতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে।
স্বীকার করতে হবে সম্প্রতি মিরপুর ও আশুলিয়ায় সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় যে দুজন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন, তার পেছনে যেমন সতর্কতার অভাব ছিল, তেমনি ছিল পেশাদারির ঘাটতিও। কোথায় কোন তল্লাশিচৌকিতে কতজন সদস্য রাখা হবে, কে নেতৃত্ব দেবেন—সেসব বিষয়ে কি সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা ছিল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্তরা ছিলেন বয়সে নবীন। কিন্তু সেই নবীনদের কি যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। হলে এমনটি হওয়ার কথা নয়।
প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে নিরাপত্তাচৌকিতে পুলিশের যতটুকু সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটুকু নেওয়া হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী একজন যখন তল্লাশি করবেন, অন্যজন তখন পাহারা দেবেন।’
এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নিতে হয়, সেই প্রশিক্ষণ কি তাদের দেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত হয়নি।
আর পুলিশ বিভাগের আরেকজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, পুলিশ বিভাগের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি এখন আর এই বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেই। এটি পুরোপুরি চলে গেছে রাজনৈতিক নেতা তথা সাংসদদের হাতে। তাঁরাই ঠিক করে দেন কোন পদে কাকে নিয়োগ করা হবে, কাকে কোথায় পদায়ন করা হবে। এখানে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়নের সুযোগ খুব কম। তিনি আরও বলেছেন, পাঁচ-দশ লাখ টাকা দিয়ে কেউ পুলিশ বিভাগে ঢুকলে তাঁর প্রধান দায়িত্ব হয়ে পড়ে সেই টাকাটি দ্রুত তুলে নেওয়া। সে ক্ষেত্রে ন্যায় ও সততার পাশাপাশি পেশাগত দক্ষতাও নিহত হয়। তদুপরি কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ তো আছেই।
আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা নয়। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। আশুলিয়ার ঘটনার পর তল্লাশিচৌকিগুলোতে জনবল বাড়ানো হয়েছে। হয়তো এর কিছুটা ফলও পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাবে। তাদের হাতে অস্ত্র আছে। কিন্তু যারা নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ মানুষ, তাদের নিরাপত্তা কে দেবে? তারাও নিশ্চয়ই চাইবে না প্রকাশনা সংস্থার অফিস খুলে ফয়সলের মতো বেঘোরে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে কিংবা টুটুলের মতো গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাতে? তারা নিশ্চয়ই চাইবে না ঘরে বা বাইরে দুর্বৃত্তদের হানায় বাবা সন্তানকে কিংবা স্ত্রী স্বামীকে হারান।
আমাদের সমাজে কিছু ভাগ্যবান মানুষ আছেন, যারা সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র রাখতে পারেন। শুনেছি আরও বেশি ভাগ্যবান যারা তারা প্রাইভেট বাহিনীও গড়ে তোলেন। আবার এসব অনুমোদিত অস্ত্রের বেআইনি ব্যবহারও আমরা দেখেছি। কিন্তু আমাদের উদ্বেগ হলো একেবারেই সাধারণ মানুষকে নিয়ে, যাদের দল নেই, সংঘ কিংবা সংঘবদ্ধ বাহিনী নেই, তাদের কী হবে? সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত প্রকাশক ফয়সলের শোকাহত পিতা বলেছেন, ‘আমি আমার নিরাপত্তায় পুলিশ চাই না। আমি চাইলে হয়তো সরকার পাঁচজন পুলিশ পাঠাবে। কিংবা তার চেয়েও বেশি পাঠাবে। কিন্তু দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কী হবে? তারা কার কাছে নিরাপত্তা চাইবে?’
আসলে নিরাপত্তা তো চাওয়ার বিষয় নয়। যেকোনো রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া। নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই তো আমরা পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা, বিজিবি, সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছি। সাধারণ মানুষের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। তারা নিরস্ত্র। এই নিরস্ত্র মানুষ তখনই নিরাপদ বোধ করবে, যখন দেখবে রাষ্ট্র অপরাধীদের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে। আইনের প্রয়োগে কোনো বৈষম্য বা ব্যত্যয় ঘটছে না। এ কারণেই যেকোনো ফৌজদারি অপরাধকে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে চালিত অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। প্রতিকারের উদ্যোগ নেয়। যে রাষ্ট্র যত কার্যকরভাবে সেই প্রতিকার করতে পারে, সেই রাষ্ট্রেই নাগরিকেরা তত নিরাপদ ভাবে। রাষ্ট্রের আরেকটি কর্তব্য হলো, জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো। আধুনিক যুগে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র মৌলিক চাহিদা নয়। এর সঙ্গে তার নাগরিক অধিকার তথা পছন্দমতো প্রতিনিধি বাছাই এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাও তাকে দিতে হবে।
আমরা ধরে নিলাম, পুলিশ সদর দপ্তর যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, সেটি পুরোপুরি প্রতিপালিত হলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আরও সজাগ ও সতর্ক থাকলেন। তাঁদের প্রত্যেককে লাগসই প্রযুক্তি, সরঞ্জাম ও অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হলো। এসব বাহিনী এমনভাবে গড়ে তোলা হলো যে কেউ তার কোনো সদস্যের ওপর আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। সেই সঙ্গে এই নিশ্চয়তাও রাষ্ট্রকে দিতে হবে যে তার আইনানুগ বাহিনীর কোনো সদস্য বেআইনি কিছু করবেন না। দল-মত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে সমদৃষ্টিতে দেখবে। সেই রাষ্ট্র কেবল দুষ্টের দমনই করবে না, দুষ্ট যাতে তৈরি হতে না পারে, সেই ব্যবস্থাও তাকে নিতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তখনই নিরাপত্তা বোধ জাগ্রত হবে, যখন রাষ্ট্র ন্যায়ানুগ আচরণ করবে। সমাজে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হবে। আর আক্রান্ত মানুষ পাবে ন্যায়বিচার।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.