খোলাসা হচ্ছে না কিছুই by সাজেদুল হক ও রুদ্র মিজান

উদ্বেগ-আতঙ্কের ৪০ দিন। সিজার তাভেলা হত্যা দিয়ে শুরু। সর্বশেষ আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যা। একের পর এক অঘটন। হুমকির পর হুমকি। ভয় আর আতঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ। সন্ত্রাসের একটি নতুন অধ্যায়েই যেন প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে সন্ত্রাসী আক্রমণে নিহত প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের পিতা প্রবীণ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি এমন আতঙ্ক বোধ করতেন। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় কোন কিছুই খোলাসা হচ্ছে না। এসব হামলায় কারা জড়িত তার কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
৪০ দিনের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায়, ২৮শে সেপ্টেম্বর সিজার তাভেলা হত্যার পর ৩রা অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানের নাগরিক হোশি কুনিও। ৫ই অক্টোবর মধ্য বাড্ডায় নিজ বাসায় হত্যার শিকার হন কথিত পীর ও পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান। ২২শে অক্টোবর দারুস সালামে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ছুকিরাঘাতে নিহত হন পুলিশের এএসআই ইব্রাহীম মোল্লা। ২৩শে অক্টোবর দিবাগত রাতে হোসনি দালানে আশুরার প্রস্তুতি সভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দুজন নিহত হন। ৪ঠা নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারান পুলিশ কনস্টেবল মুকুল হোসেন।
কয়েকটি রাষ্ট্র কেন সতর্কতা জারি করেছিল
২৬শে সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড জানায়, তারা অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য দপ্তরের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন যে, জঙ্গিরা বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান স্বার্থের ওপর হামলা করতে পারে। এ তথ্য পাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট টিমের বাংলাদেশ সফর পিছিয়ে দেয়া হয়। পরে ওই সফর স্থগিতই হয়ে যায়। এখন জানা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা- এই পাঁচটি দেশের জোট গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিল যে, বাংলাদেশে পশ্চিমা স্বার্থের ওপর হামলা হতে পারে। এ তথ্য পাওয়ার পর কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ সফরের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের এক প্রতিনিধিকে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে আইএস সংগটিত হচ্ছে- এমন তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাটও পরিষ্কার করে বলেছিলেন, হামলার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে তথ্য দেয়া হয়েছিল। সরকারের তরফে অবশ্য এ ব্যাপারে দুই ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছিলেন, তারা তথ্য দিয়েছিল। তবে যেখানে হামলার কথা বলা হয়েছে, সেখানে হামলা হয়নি। অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, এ ধরনের কোন তথ্য কোন বিদেশী রাষ্ট্র দেয়নি। এখন পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, কথিত বড় ভাইয়ের নির্দেশে ভাড়াটিয়া খুনিরা বিদেশী নাগরিক হত্যা করতে পারে, সে তথ্যের কারণেই কি একাধিক রাষ্ট্র সতর্কতা জারি করেছিল।
‘আইএসের দায় স্বীকার’, সরকারের প্রত্যাখান
বাংলাদেশে গত ৪০ দিনে সংঘটিত অঘটনগুলোর মধ্যে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যা, আশুরার প্রস্তুতি সভায় হামলা এবং সাভারে পুলিশ হত্যার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি সংগঠন আইএস। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ দায় স্বীকারের প্রাথমিক খবর দেয় যুুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ। বাংলাদেশ সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ দাবি অস্বীকার করেছে। তারা পরিষ্কার করে বলছেন, বাংলাদেশে আইএসের কোন অস্তিত্ব নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাইট ইন্টিলিজেন্সের এ খবর প্রচারের পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। যদিও সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে আইএসের তৎপর থাকার তথ্য রয়েছে। ওদিকে, সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ এক বিবৃতিতে বলে, যাছাই-বাছাই করে তারা নিশ্চিত হয়েই আইএসের বার্তা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার পরামর্শও দিয়েছে তারা।
দোষারোপের রাজনীতি
দোষারোপের রাজনীতি বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটনার পরপরই দায়ী করা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াতকে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, লন্ডনে বসে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ষড়যন্ত্র করছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ লন্ডন থেকে আসছে বলেও দাবি করেছেন তারা। অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী স্বার্থের রাজনীতি অনেক পর্যবেক্ষককেই হতবাক করেছে।
তদন্তে অগ্রগতি সামান্য
গত ২৩শে অক্টোবর বোমা হামলায় রক্তাক্ত হয় শিয়া মুসলিমদের পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় কিশোর সাজ্জাদ। আহত হন শতাধিক মানুষ। পরে আরও একজন নিহত হন। এ ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। ডিবি পুলিশের একাধিক টিম এ বিষয়ে তদন্ত করলেও কোন ক্লু উদঘাটন হয়নি। যদিও ঘটনার পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করা হয়েছিল।
গত ২২শে অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীতে চেকপোস্টে তল্লাশি করার সময় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে দারুসসালাম থানার এক এএসআই নিহত হন। তার নাম ইব্রাহীম মোল্লা। চেকপোস্টে পুলিশ হত্যার ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে মাসুদ রানা সোহেল নামে একজনকে আটক করা হয়। পরবর্তীকালে আরও পাঁচজনকে আটক করা হলেও মূল অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশ যার নাম বলেছে তাকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
৪ঠা নভেম্বর ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এতে গুরুতর আহত হন কনস্টেবল নূর আলম সিদ্দিক (২২)। এখনও এ ঘটনার কোন ক্লু উদঘাটন হয়নি। এ বিষয়ে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল কাদির বলেন, পুলিশের একাধিক টিম এ ঘটনার তদন্ত করছে।
ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। গত ৩১শে অক্টোবর বিকালে আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় দীপনের জাগৃতি প্রকাশনীতে ঢুকে তাকে হত্যা করা হয়। ওই দিনই অভিজিৎ রায়ের আরেক প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলের লালমাটিয়ার শুদ্ধশ্বরের অফিসে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এসময় আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, লেখক সুদীপ কুমার বর্মণ ওরফে রণদীপম বসু ও তারেক রহিম গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
রংপুর জেলার কাউনিয়ায় জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যা মামলায় হুমায়ুন কবির হীরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ ঘটনায় বিএনপি নেতা হাবীন-উন নবী খান সোহেলের ভাই রাশেদুন নবী খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানে গুলি করে হত্যা করা হয় ইতালিয়ান নাগরিক সিজার তাভেলাকে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। সর্বশেষ বিএনপি নেতা এমএ কাইয়ুমের ছোট ভাই এমএ মতিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার অনেকের বাসা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন ইতালিয়ান দূতাবাসের কর্মকর্তারা। যাদের গ্রপ্তার করা হয়েছে তাদের গ্রেপ্তারের সময় নিয়েই সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। পুলিশ এবং পরিবারের পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, তাভেলা হত্যার ক্লু উদ্ধার ও আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অনেকে ১৬৪ ধারায় দায় স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত অন্যদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি। হোসনি দালানে তাজিয়া মিছিলে হামলা ও প্রকাশক দীপন হত্যার ঘটনায় এখনও কাউকে আটক করা না গেলেও ডিবির দক্ষ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন। তবে গাবতলীতে পুলিশ হত্যার ঘটনায় ছয়জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.