শূকর-ডাকা ব্যাঙ by আ ন ম আমিনুর রহমান

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিঃপরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ৮ সেপ্টেম্বর রাতে সহকর্মী ডা. আমিনুলকে নিয়ে বাবুগঞ্জ ক্যাম্পাসে গেলাম। দেশব্যাপী শিক্ষক ধর্মঘটের কারণে পরীক্ষা স্থগিত। বন্ধুসম বড় ভাই ডা. নাসিরসহ অন্যদের নিয়ে বরিশাল শহরে যাই। বরিশালের খুদে কিন্তু দুর্দান্ত পাখি পর্যবেক্ষক শাকিল আগে থেকেই সিঅ্যান্ডবি রোডে অপেক্ষা করছিল। ওকে নিয়ে সোজা রুইয়া গ্রামে। কিন্তু গ্রামে পৌঁছেই মন খারাপ হয়ে গেল। আলো ঝলমলে আকাশে হঠাৎই মেঘের ঘনঘটা। রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাখিরাও যেন কোথায় হারিয়ে গেল!
নীলকান মাছরাঙার খোঁজে শাকিল একটা ছোট্ট পুকুর ও সরু নালার কাছে নিয়ে গেল। আমি আক্ষেপ করে বললাম, পাখি না হয় পেলাম না, কিন্তু একটা ব্যাঙও কি নেই এখানে? শাকিল নালায় নীলকান মাছরাঙার চলাচলের রুট দেখাচ্ছিল। আমি কিছুটা আনমনা হয়ে নালার পাশের ছোট্ট পুকুরপাড়ের লেবুগাছটির দিকে তাকালাম। আর হঠাৎই ওকে দেখলাম। খুশিতে মনটা নেচে উঠল। শাকিলকে বললাম, ও বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিল না। শেষমেশ মোবাইলে সেভ করা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিতেই ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দুর্লভ এই প্রাণীটিকে এর আগে টেকনাফ, খাগড়াছড়ি, রাতারগুল, চুনারুঘাট, কমলগঞ্জ, পঞ্চগড় ও রংপুর ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায়নি। ওর একটা ছবি আমার খুব দরকার পরবর্তী বইয়ের জন্য। দ্রুত কয়েকটি ক্লিক করলাম।
এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে এ দেশের এক দুর্লভ উভচর প্রাণী শূকর-ডাকা ব্যাঙ (Bhamo or Groaning Frog)। এত ভদ্র প্রাণী সচরাচর দেখা যায় না। মিয়ানমারে ভামো শহরে প্রথম পাওয়া যায় বলে ভামো ব্যাঙ বা মিয়ানমারের ভামো ব্যাঙ নামেও পরিচিত। Ranidae গোত্রভুক্ত প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Humerana humeralis।
শূকর-ডাকা ব্যাঙের আকার মাঝারি। দৈর্ঘ্যে পুরুষ ৫ দশমিক শূন্য থেকে ৭ দশমিক ২ এবং স্ত্রী ৫ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক শূন্য সেন্টিমিটার। মাথা বড় ও অবতল; নাক চোখা। দেহের ওপরটা জলপাই-বাদামি, নিচটা সাদা। নাক থেকে দেহের দুই পাশ দিয়ে দুটি করে চিকন হলদে দাগ। চামড়া মসৃণ, তবে দেহের পেছনের অংশ কিছুটা দানাদার। রানের পেছনটায় সাদাটে ও গাঢ় বাদামি মার্বেলের মতো কারুকাজ। পেছনের পায়ের আঙুলগুলো পায়ের পাতার সঙ্গে যুক্ত ও সামনেরগুলো মুক্ত। আঙুলের আগায় চাকতির মতো রয়েছে।
এরা মূলত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনের আর্দ্র এলাকার বাসিন্দা। জলাভূমির কিনারা, পুকুর, জলপ্রবাহ এবং ঝোপঝাড় ও জলজ তৃণলতাসমৃদ্ধ স্বল্প পানির জলাধারে দেখা মেলে। শীতকালে ছায়াযুক্ত স্থানে, পচা পাতার ১০-৩০ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করতে পারে। এরা নিশাচর ও মূলত দলে থাকে, একাকীও দেখা যায়। কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি ও অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী খায়।
এদের প্রজনন-সংক্রান্ত তথ্য কম। মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রজনন করে। জুন-জুলাই মাসে জলাধারের কিনারায় পুরুষ ব্যাঙ শূকরের মতো করে ডাকে। আধা থেকে কয়েক মিনিট পরপর ডাকের পুনরাবৃত্তি ঘটে। স্ত্রী জলাশয়ের তীরের কাছে অল্প পানিতে ডিম ছাড়ে।
শূকর-ডাকা ব্যাঙ। ছবিটি লেখক বরিশাল শহর-সংলগ্ন রুইয়া গ্রাম থেকে এ বছরের ৮ সেপ্টেম্বর তুলেছেন

No comments

Powered by Blogger.