নির্বাচনী প্রচার: কানাডীয় স্টাইল by সাজ্জাদ আলী

আমার টরন্টোর বাসায় কয়েক দিন আগে আম্মা ও আমি দুপুরের খাবার খাচ্ছি আর এটা-সেটা নিয়ে কথা বলছি। ডাইনিং রুমের বড়সড় কাচের জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের চক্রাকার রাস্তার বেশ খানিকটাই দেখা যায়। ডেড-এন্ড হওয়ায় রাস্তাটি একেবারেই নিরিবিলি। খুব একটা গাড়ি চলাচল করে না। এ রাস্তায় যাদের বসবাস শুধু তাদেরই যাওয়া-আসা। এমন সময় একটা ভ্যানগাড়ি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।
আম্মা বললেন, কারওর কি তোর কাছে আসবার কথা?
ভ্যানটির দিকে তাকিয়েই না সূচক মাথা নাড়লাম।
গাড়ির সামনের দুপাশের দরজা খুলে একই সঙ্গে দুজন তাগড়া জোয়ান বের হলো। সাদা জন গাড়ির পেছনে গিয়ে ট্রাঙ্ক খুলছে আর কালোজন হাঁটতে হাঁটতে চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে সোজা আমাদের দরজায় নক করল। খাওয়া রেখে তার সঙ্গে মিনিট খানেকের মতো কথা বলে আবার ফিরে এলাম টেবিলে। আম্মা জানতে চাইলেন, কে এলো, কি চায়?
বললাম ওরা ভোটের লোক, আমাদের সামনের লনে ওদের প্রার্থীর একটা সাইন লাগানোর অনুমতি চাইছিল।
অনুমতি চাওয়ার বিষয়টা আম্মা বোধ হয় ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। তার বড় চোখ দুটো আরও বড় করে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এই দেশে ভোটাভুটি হবে নাকি?
টেলিভিশন বিতর্ক
বললাম, গতকালই ইলেকশন কমিশন কানাডার জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। ১৯ অক্টোবর ভোট হবে।
আম্মা বললেন, এমপি ইলেকশন হবে, কিন্তু তোদের পাড়ায় তো কোনো মিটিং মিছিল দেখছি না! কোনো সাড়াশব্দ নাই, এ কেমন ইলেকশন?
বললাম, আম্মা, গতকাল থেকে সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেলে এই ইলেকশনের কথাই বলছে। আপনি তো সারা দিন বাংলা চ্যানেল দেখেন, জানবেন কীভাবে?
আম্মা বললেন, মানে! ইলেকশনের খবর টেলিভিশনে জানতে হবে কেন? আম্মা খানিকটা রাগান্বিত। বললেন, তোদের পাড়ায় দলীয় পোলাপান নাই, তারা মিছিল-স্লোগান দেবে না?
আমার বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিনই রাজনীতি করেছেন। আম্মা কৈশোরে বালিকাবধূ বেশে স্বামীর বাড়িতে এসে সেই রাজনীতির নেপথ্য হাল ধরেছিলেন। নির্বাচন তো তার অনেক চেনা ও আগ্রহের বিষয়ও বটে। কিন্তু একি দেখছেন? দেশে এমপি ইলেকশন অথচ পাড়ায় মিটিং-মিছিল নাই, বাড়িগুলোর দেয়ালে কোনো চিকা মারা হয় নাই, রাস্তার ওপর দিয়ে দড়ি টাঙ্গিয়ে কোনো পোস্টার সাঁটানো দেখা যাচ্ছে না, কোথাও কোনো তোরণ নির্মাণ করা নাই, এ কেমন ইলেকশন?
ততক্ষণে আমাদের লনের ঘাসে কাঠের দুটো চিকন খুঁটি গেড়ে লিবারেল পার্টির প্রার্থীর একটা প্লাস্টিক সিটের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়ে তারা অন্য বাড়িগুলোর দিকে চলে গেছে। আম্মা সাইনটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলেন, ওটা লাগাতে ওরা তোর অনুমতি চাইল? আমি হ্যাঁ বলতেই আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুই অনুমতি না দিলে কি করত, লাগাত না?
বললাম আম্মা কী বলছেন, অনুমতি না পেলে লাগাবে কীভাবে? এটাতো আমাদের প্রোপার্টি।
বাংলাদেশে ইলেকশন করা মা আমার এবারে ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আরে রাখ তোর প্রোপার্টি, ইলেকশন বলে কথা! ছেলেপেলে পোস্টার লাগাবে না? এর জন্য আবার অনুমতি চাওয়া-পাওয়ার কী আছে?
নির্বাচনী সভায় লিবারেল পার্টি প্রধান জাস্টিন ট্রুডো
নির্বাচনী প্রচার নিয়ে আমার মায়ের বোঝাপড়াটা ঠিক কানাডীয় আদলের সঙ্গে মিলল না। কানাডার জাতীয় সংসদ চার বছর মেয়াদি। মোটা দাগে বললে বলতে হয় যে, সাধারণ কানাডীয়রা রাজনীতি বা নির্বাচন নিয়ে তেমন উৎসাহী নয়। অতি উৎসাহী তো অবশ্যই না। এখানে প্রধান রাজনৈতিক দল তিনটি। ১) কনজারভেটিভ। দলটি বর্তমানে ক্ষমতায়। এদের আমেরিকা ঘেঁষা ও ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২) লিবারেল। ঐতিহ্যবাহী এই দলটি বহু বছর কানাডা শাসন করেছে। বলা হয়ে থাকে যে এরা ইমিগ্রান্ট বান্ধব দল। ৩) নিউ ডেমোক্র্যাট। এরা বামপন্থী হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দলটির জনপ্রিয়তা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইলেকশন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে কোনো প্রার্থীই নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন না। প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা ক্রীড়া বিষয়ক অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত হয়ে ভোটারদের সমর্থন চান। এলাকার বিভিন্ন সংগঠন, গ্রুপ ও কমিউনিটি সেন্টারগুলো নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নির্বাচনী সভা আহ্বান করে। সব দলের প্রার্থীরা সেই সভায় একই মঞ্চে উপস্থিত হয়ে এলাকার উন্নয়নের বিষয়ে তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা ভোটারদের কাছে তুলে ধরেন। এসব নির্বাচনী সভা ওই নিরপেক্ষ আয়োজকদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রার্থীদের সুনির্দিষ্ট বিষয়েই কথা বলতে হয়। কোনো কাদা ছোড়াছুড়ি সুযোগ নেই। দলীয় কর্মীরা কেউ ‘অমুক ভাইয়ে চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’ বলে স্লোগান দেন না। কমিউনিটি ভিত্তিক এই সভাগুলোতে হাজার হাজার লোকের সমাগমও ঘটে না। শ খানেক লোক হলেই আয়োজকেরা খুশিতে বাকবাকুম। এ ধরনের ছোট্ট ছোট্ট সমাবেশকেই কানাডীয়রা নির্বাচনী জনসভা বলে বিবেচনা করে থাকে।
সরকারি বা বেসরকারি কোনো ভবন বা স্কুল কলেজগুলোর দেয়ালে কোনো প্রচার লেখন নেই। কানাডায় ছাত্র রাজনীতি বলে কোনো শব্দ কারও জানা নেই। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের সংগঠন আছে, তবে সে সংগঠনগুলো কেবলমাত্র শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে, রাজনীতি নয়। প্রার্থীরা তাদের ওয়েব পেজ, ফেসবুক, টুইটারে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো ভোটারদের কাছে বলেন। দলীয় কর্মীরা কখনো সখনো লিফলেট আকারে তাদের প্রার্থীদের ভোট প্রার্থনা ভোটারদের বাড়ির ডাকবাক্সে রেখে যান। কানাডায় অঞ্চলভিত্তিক রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল আছে। এ সব আঞ্চলিক ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো সমতার ভিত্তিতে প্রার্থীদের প্রচারের জন্য সময় বরাদ্দ করে। স্থানীয়ভাবে ভোটাররা এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এলাকার প্রার্থীদের পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে অবহিত হন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভোট চাওয়ার রীতি (ক্যানভাস) এ দেশে নেই বললেই চলে।
কানাডায় নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম মাধ্যম লন সাইন
রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্রীয়ভাবেও প্রচার চালায়। দলীয় প্রধানেরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর করে নির্বাচনী সভায় বক্তব্য রাখেন। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন প্রচারমাধ্যমগুলো এসব বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করে। কখনো বা দলীয় প্রধান পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কোনো ব্যস্ত ট্রেন স্টেশন বা শপিংমলে উপস্থিত হয়ে জনসাধারণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। জনমত জরিপ ও জরিপের ফলাফল কানাডীয় নির্বাচনে বিশেষ প্রভাব রাখে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন, এই জরিপগুলোর ফলাফল তাদের প্রভাবিত করে।
কানাডায় সরকারের কোনো প্রচারমাধ্যম নেই (রেডিও, টেলিভিশন বা সংবাদপত্র)। তার প্রয়োজনও পড়ে না। এখানে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সবই স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বাধীন। অত্যন্ত প্রভাবশালী এই মিডিয়াগুলো নির্বাচনের পূর্বে জাতীয় পর্যায়ে একাধিক নির্বাচনী বিতর্কের আয়োজন করে। সঞ্চালকের কঠোর নিয়ন্ত্রণে দলীয় প্রধানেরা একই মঞ্চে উপস্থিত হয়ে পূর্ব নির্ধারিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির ওপরে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন। এখানে তারা একে অন্যের প্রশ্নের জবাব দেন বা বক্তব্য খণ্ডন করেন। দলীয় প্রধানদের নিয়ে আয়োজিত ও সরাসরি সম্প্রচারিত এই টেলিভিশন তর্ক অনুষ্ঠান কানাডার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের ভোটাররা মনোযোগ দিয়ে দেখেন। ধারণা করা হয় এই টেলিভিশন বিতর্কগুলোতে দলীয় প্রধানদের পারফরমেন্সই নির্বাচনে দলের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।
লেখক
এ লেখার শুরুতে বলছিলাম বাড়ির সামনের লনে সাইন পোস্ট করার জন্য দলীয় কর্মীদের অনুমতি চাইবার কথা। ভোটে জয় পরাজয় যাই হোক নির্বাচন শেষ হওয়ার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে সেই সাইন তাদের তুলেও নিতে হবে। ওই অনুমতি চাওয়া বা সাইনটি তুলে নেওয়া শুধু ভদ্রতা নয়, এ দেশের আইনও বটে। এ আইন না মানলে প্রার্থীর শাস্তি হবে আর ওই ভদ্রতাটুকু না দেখালে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ভোট-ভরাডুবি হবে। এমনটাই কানাডীয় ভোটারদের মানসিকতা। তো আমার আম্মা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ভোট শেষ হলে ওরা আমাদের লন থেকে সাইনটি তুলে নেয় কি না, সেটা দেখার জন্য!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার মুখ্য নির্বাহী)

No comments

Powered by Blogger.