হুমকি এক, প্রতিক্রিয়া ভিন্ন by কামাল আহমেদ

ব্রিটেনের সামরিক গোয়েন্দা দপ্তর, যা এমআই ফাইভ নামে পরিচিত, তার ওয়েবসাইটে গেলে যে কেউই দেখতে পাবেন যে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে তাদের দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি হচ্ছে ‘তীব্র’। ইংরেজিতে তারা যে শব্দটি ব্যবহার করেছে, সেটি হচ্ছে সিভিয়ার। কিন্তু বিশ্বের অন্য কোনো দেশের কোনো নাগরিক সে দেশ থেকে চলে আসছেন অথবা পরিকল্পিত সফর বাতিল করছেন, এমন কোনো খবর আমরা শুনিনি। আমাদের পরিচিতজনেরা দিব্যি সেখানে যাচ্ছেন এবং লন্ডন, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, এডিনবরা অথবা কার্ডিফের মতো শহরগুলোতে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছেন। কোনো দেশের সরকার ব্রিটেনের অন্যতম প্রধান উপার্জনের খাত ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তাদের ছাত্রছাত্রীদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশও দেয়নি। নিরাপত্তার বিষয়গুলো যাঁদের দেখভাল করার কথা, তাঁরাই সে কাজটি করছেন এবং এ বিষয়ে রাজনীতিকদের কোনো বিতণ্ডা নেই। অথচ সেই ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশে অবস্থানরত বা সফরকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের উদ্দেশে যে ভ্রমণ-সতর্কতা জারি করেছে, তা নিয়ে আমাদের দেশে চলছে নজিরবিহীন তোলপাড়—যার অনেকটাই মূলত রাজনৈতিক। এর শুরুটা অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিলের সময় থেকে।
ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে তাদের নাগরিকদের জন্য সব দেশে ভ্রমণের ব্যাপারেই নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই পরামর্শের পাতায় অস্ট্রেলিয়া সফরের বিষয়েও পরামর্শ আছে এবং সেটা প্রায় বাংলাদেশের মতোই। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সন্ত্রাসবাদের হুমকি অনেক বেশি। অস্ট্রেলিয়ার সরকার তার সন্ত্রাসবিষয়ক সরকারি সতর্কতা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে “উঁচু” বলে চিহ্নিত করেছে। হামলাগুলো হতে পারে এলোপাতাড়ি বা নির্বিচার। যেসব জায়গায় বিদেশিরা যান, সেসব জায়গাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।’
আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে ভ্রমণ-সতর্কতা ব্রিটেন প্রকাশ করেছে, ৯ অক্টোবর তাতে বলা হয়েছে, ‘সন্ত্রাসবাদের হুমকি অনেক বেশি। আইএসআইএল (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লিভেন্ট, যার সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে আইএস) সম্প্রতি দুজন বিদেশিকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। পশ্চিমাদের ওপর আরও হামলা হতে পারে, সেসব হামলা নির্বিচারেও হতে পারে।’ অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য ভ্রমণ-সতর্কতায় সন্ত্রাসবাদের হুমকির মাত্রা যে খুব আলাদা, তা কিন্তু নয়। তফাতটা শুধু একটি বাড়তি তথ্যে, যেখানে বাংলাদেশে দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যায় আইএসের দায় স্বীকারের কথা বলা হয়েছে। অথচ প্রতিক্রিয়ায় যে ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়া ছাড়া অন্য কোনো অগ্রগতির কথা কেউ বলতে পারছেন না।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে গত দেড় দশকে ব্রিটেনে অনেকবার বড় ও মাঝারি ধরনের নিরাপত্তা সতর্কতা জারি হয়েছে। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবার হিথ্রো বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সাঁজোয়া যানসহ সেনা মোতায়েন পর্যন্ত হয়েছিল। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে বিমানযোগে যাতায়াতের জন্য যেসব নিরাপত্তা তল্লাশির ব্যবস্থা এখন পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে চালু হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই প্রথম শুরু হয় ব্রিটেনে। এমনকি গত বছরেই আটলান্টিকের দুই পারের মধ্যে চলাচলকারী বিমানগুলোতে হামলা হতে পারে, এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নতুন করে সব যাত্রীর শারীরিক তল্লাশি বাধ্যতামূলক করা হয়। এসব সতর্কতা জারির কারণে প্রথম প্রথম বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা কিছুটা কমলেও পরে তা আবার ঠিক হয়ে যায়। উপরন্তু, লন্ডেন অলিম্পিকের বছর থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশে দুই বিদেশির সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের পর ইসলামি জঙ্গিদের নতুন বৈশ্বিক আপদ, আইএসের দায় স্বীকারকে কেন্দ্র করে যে নতুন বিপত্তি ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে, সেটাও আমাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। তবে আইএসে যোগ দেওয়ার সংখ্যাগত দিক থেকে ব্রিটেন সম্ভবত ইউরোপে অন্যদের চেয়ে অনেক ওপরে। আইএসে যোগ দেওয়া ঠেকাতে ব্রিটেন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার মধ্যে এমন ব্যবস্থাও আছে যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কারও আচরণে ইসলামি মৌলবাদী হওয়ার কোনো আলামত দেখা যায় কি না, তার ওপর নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পৌর (স্থানীয় সরকার) কর্তৃপক্ষগুলোকে। স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী কিংবা অভিভাবক যদি নিজের সন্তান অথবা অন্য কারও মধ্যে এমন কোনো আলামত দেখেন, তাহলে তা পৌর কর্তৃপক্ষকে জানানো এখন বাধ্যতামূলক। এরপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ওই সন্দেহভাজনের সঙ্গে কথা বলে তাকে মৌলবাদের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেন। বেড়ে যায় তার ওপর নজরদারি এবং প্রয়োজনে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। এসব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পাসপোর্ট জব্দ করার মতো ব্যবস্থাও আছে, যাতে সে দেশ ত্যাগ করতে না পারে। ৮ অক্টোবর বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে যে দৈনিক গড়ে আটজন করে তরুণকে এই কর্মসূচিতে পাঠানো হচ্ছে। কর্মসূচিটি চ্যানেল নামে পরিচিত। পুলিশের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে তারা জানিয়েছে, গত তিন মাসে ৭৯৬ জনকে এই কর্মসূচিতে পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই বয়স আঠারোর কম। তাদের এই কর্মসূচির সাফল্য নিয়েও অবশ্য অনেক প্রশ্ন উঠছে এবং অভিযোগ উঠছে অযথা হয়রানি ও বৈষম্যমূলক আচরণের।
ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পাশ্চাত্যের কোনো দেশই সন্ত্রাসবাদের হুমকি থেকে মুক্ত, এমনটা দাবি করতে পারবে না। এমনকি সন্ত্রাসবাদে যুক্ত জঙ্গিদের অনেকে যে ওই সব দেশ থেকেই অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, সে কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। ২ অক্টোবর ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকবার্নের ১৪ বছর বয়সী এক ছেলেকে সে দেশের আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। কারণ সে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের অ্যানজ্যাক দিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করেছিল (অ্যানজাক ডে টেরর প্লট: ব্রিটিশ টিনএজার গিভেন লাইফ সেনটেন্স, দ্য গার্ডিয়ান, ২ অক্টোবর, ২০১৫)। ওই ছেলেটিকে ব্রিটেনের কনিষ্ঠতম জিহাদি অভিহিত করে বলা হচ্ছে, বিদেশের মাটিতে এ ধরনের হামলা চালানোর এই অভিনব চেষ্টায় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা হতবাক। বাংলাদেশেও একাধিক সন্ত্রাসী পরিকল্পনার অভিযোগে একাধিক ব্রিটিশ নাগরিককে গ্রেপ্তার ও তাদের আটক থাকার কথাও আমরা জানি।
এসব তথ্যের পটভূমিতে কেউ কেউ বলতে পারেন যে সন্ত্রাস রপ্তানির জন্য পশ্চিমারা বিশেষত ব্রিটিশরা অনেকাংশেই দায়ী, আবার তারাই আমাদের দেশে সন্ত্রাসী হুমকির অজুহাতে ভীতি ও অস্থিরতা তৈরি করছে। কিন্তু এ ধরনের সরলীকরণ সমস্যাটির কোনো সমাধান দেবে না। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর দেশের সন্ত্রাসীদের সামাল দেওয়ার কথা আমরা বলতেই পারি। কিন্তু আমাদের দেশের জঙ্গিদের মোকাবিলার প্রশ্নটিকে রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়ে রূপান্তরিত করা কতটা যৌক্তিক? যে দুই বিদেশির হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিদেশিদের এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সেই ঘৃণ্য অপরাধের সুরাহা তাৎক্ষণিকভাবে হয়ে যাবে, এমনটি কেউই আশা করেন না। কিন্তু তদন্ত চলার সময়ে হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য, আলামত ও অন্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর বিচার-বিশ্লেষণের আগেই যদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করা হয়, তাহলে বিদেশিরা আশ্বস্ত হবেন কীভাবে? রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করার জন্য নানা ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচারকাজকে প্রভাবিত করা অথবা বিভ্রান্ত করার নজির কি এ দেশে কম? নাকি সেগুলোর কথা বিদেশি বন্ধুরা জানেন না?
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সন্ত্রাসবাদের হুমকি একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। আর সে কারণেই তা মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় গোপন এবং প্রকাশ্য নানা ধরনের সহযোগিতা চুক্তি আছে। এসব দেশের একসঙ্গে কাজ করার অসংখ্য নজিরও আছে। বাংলাদেশের নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা ঢাকার রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে বিশেষ বিমানে করে নিউইয়র্কে নিয়ে বিচারও করেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁদের নিরাপত্তাগত সহযোগিতা না থাকলে এমনটি সম্ভব ছিল না। একইভাবে বাংলাদেশে একজন ব্রিটিশ সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার হওয়ার পর লন্ডনে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছেন, সে খবরও আমরা ব্রিটিশ পত্রপত্রিকার কল্যাণে জেনেছি।
শত্রুতা না থাকলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টি যেমন স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবিলায় সহযোগিতার উদ্যোগও প্রত্যাশিত বিষয়। এ ক্ষেত্রে কোনো দেশ যদি সহযোগিতা না করে অথবা কোনো দেশের সহযোগিতার প্রস্তাব যদি সরকার ফিরিয়ে দেয়, তাহলে সেটি হবে একটি গুরুতর ব্যতিক্রম। সে কারণেই আইএসের দাবির বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে তদন্তে সম্পৃক্ত হতে চাওয়া কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। যদিও জঙ্গি হামলার গোয়েন্দা তথ্য আগাম জানানো হয়েছিল কি হয়নি, সে বিষয়ে প্রকাশ্য বিতর্কে খুব একটা ভালো ইঙ্গিত মেলে না। তবে রাজনীতিকদের প্রকাশ্য খেদ, হতাশা অথবা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সম্পর্ককে প্রভাবিত না করলেই ভালো।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.