মেডিকেলে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষের পথে, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের সুরাহা হয়নি by শেখ সাবিহা আলম

মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ‘ফাঁসের’
প্রতিবাদে এবং পুনরায় ভর্তি পরীক্ষার দাবিতে কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনার এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ, পরীক্ষার্থীদের আন্দোলন, র‌্যাবের অভিযান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক কর্মকর্তার মৃত্যু, দুই দফায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দোষ দাবি—এরই মধ্য দিয়ে দেশের ২৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি প্রায় শেষ। আগামী ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ক্লাস।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক খালেদ সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীক্ষার দিন থেকে আমরা প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে আন্দোলন শুরু করেছি। সরকার একবারের জন্যও আমাদের অভিযোগটা শুনল না।’ এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসার প্রশ্নই আসে না। আমি কখনোই তাদের সঙ্গে বসব না।’
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের সুষ্ঠু সুরাহা না হওয়ায় মেডিকেলে ভর্তি হওয়া অনেক শিক্ষার্থী বিপাকে পড়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে কি হয়নি, সে প্রসঙ্গ আলাদা। ঢাকা মেডিকেল কলেজে একজন ওঝার ছেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। ভর্তির সুযোগ পেয়েছে নটর ডেম কলেজের প্রথম হওয়া ছাত্রও। তার বাবা ভর্তির সময় রেজাল্ট কার্ডসহ এসেছিলেন। দুঃখ করে বলছিলেন, লজ্জায় ছেলের খবর কাউকে দিতে পারছেন না।’
বিতর্ক যে কারণে: আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পরীক্ষার তারিখ ২ অক্টোবর থেকে ১৮ সেপ্টেম্বরে নিয়ে আসা, পরীক্ষার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এবং প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে তিনটি তদন্ত চলার সময় ফল ঘোষণা প্রমাণ করে, পুরো প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ছিল।
যে চিকিৎসকেরা মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের কারও কারও এবার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কলা ভবনে পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্বে ছিলাম। কয়েকজন শিক্ষার্থী ১৫ মিনিট পরই খাতা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি তাদের খাতাগুলো চেক করে দেখি তারা ১০০টি প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে।’ একই তথ্য দিয়েছেন তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজে পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা আরেক চিকিৎসক।
অভিযোগ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের অবস্থান: গত ১৮ সেপ্টেম্বর এমবিবিএস-বিডিএস কোর্সে ভর্তি পরীক্ষার পরদিন থেকে একযোগে দেশের ১০টি জেলায় শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নমুনা প্রশ্ন হাতে নিয়ে আন্দোলনে নামেন। ৪ অক্টোবর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, তিনি নিশ্চিত প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। ওই সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেন, প্রশ্ন যেখানে ছাপা হয়, সেটি সাতটি তালা দিয়ে বন্ধ করা হয়, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ সত্য নয়।
ওই মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকেরাও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা নেওয়ার প্রস্তাব করেন। মন্ত্রী এই প্রস্তাবকে ‘গুড অ্যাডভাইস’ বললেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
গত ৮ অক্টোবর এক বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দেশের ২৯টি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, হাসপাতালের পরিচালক, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করতে নির্দেশ দেন। ভর্তি প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটানোর কোনো প্রচেষ্টা ‘বরদাশত’ করা হবে না বলে জানান। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজের কোনো শিক্ষার্থী যেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে আন্দোলনে না নামেন, সে ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেন কলেজ কর্তৃপক্ষকে।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, পুরান ঢাকার সাংসদ হাজি মো. সেলিম, চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও সরকার-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) প্রতিনিধিরা।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএমএকে মন্ত্রণালয়ের পাশে দাঁড়াতে বলা হয়। তবে এ বিষয়ে বিএমএর মহাসচিব এম ইকবাল আর্সলানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
যা বলছে অধিদপ্তর: অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মো. নুরুল হক বলেছেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কোনো কাজের সঙ্গে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা পরিচালক-শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এর আগে অধিদপ্তরে পরিচালক-শিক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন এমন একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমবিবিএস-বিডিএস ভর্তি পরীক্ষার কাজ করে ভর্তি কমিটি এবং প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, বাছাই ও মুদ্রণ কমিটি। ভর্তি কমিটিতে শুধু অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা থাকেন। ওই কমিটি পরীক্ষার আবেদনপত্র গ্রহণ, যাচাই-বাছাই, প্রবেশপত্র দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিকেও দাপ্তরিক সাহায্য করেন অধিদপ্তরের শিক্ষা বিভাগের পরিচালক। তবে সদ্য অবসর প্রস্তুতি ছুটিতে যাওয়া, শিক্ষা বিভাগের সাবেক পরিচালক এ বি এম আবদুল হান্নান বলেছেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থকে পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্র মেডিকেল কলেজগুলোকে বুঝিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সব দায়িত্ব পালন করেছে চার শিক্ষকের একটি কমিটি। তিনি কোনোভাবেই এ কাজে যুক্ত ছিলেন না।
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ যথাযথভাবে খতিয়ে না দেখার অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বক্তব্য ছিল, রংপুর, বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রামে প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও ‘ওই চার কেন্দ্র থেকে ‘উল্লেখযোগ্য’সংখ্যক শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজের জন্য নির্বাচিত হননি। তাই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিতান্তই গুজব ও ভিত্তিহীন।
র‌্যাব যা বলছে এখন: মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গত ১৫ ও ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় দুটি ও ২২ সেপ্টেম্বর রংপুরে একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তা ওমর সিরাজসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১ অক্টোবর ওমর সিরাজ র‌্যাব হেফাজতে মারা যান। গত রোববার (১১ অক্টোবর) র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই চক্রটি মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কি না, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’ রংপুরে র‌্যাব যে তিন চিকিৎসকসহ সাতজনকে ধরেছে, সে মামলাটির অগ্রগতি কতটুকু তা তিনি জানাতে পারেননি। তবে ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এই চক্রটি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগ, মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা নিয়োগসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের পরীক্ষায় জালিয়াতি করে আসছিল।
র‌্যাবের তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দাবি করে, তিনটি চক্রের কারও কাছেই এমবিবিএস ও বিডিএস ভর্তি পরীক্ষা-সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.