জাপানি নাগরিক হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে কোন অগ্রগতি নেই

পিস্তল বা রিভলবারের গুলিতে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে হত্যা করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তাররা এমনটাই জানিয়েছেন। রংপুর জেলা পুলিশও জাপানি নাগরিক হত্যার ক্লু খুঁজছেন। এজন্য বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তারা। হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে মাঠে নেমেছে র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। রংপুর পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক রংপুর রেঞ্জের ডিআইজির কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল থেকে আলামত হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্রের তিনটি গুলির খোসা জব্দ করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ঘটনায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারে জোর পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত আছে। গতকাল এ ঘটনায় একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে রংপুর মহানগর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সতর্কতা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার জাপানের নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকায় জাপানের দূতাবাসের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মি. কিনজু, তার সহকারী রহমান এবং কারসিয়া মজিয়া নামে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রংপুরে আসেন। তারা প্রথমে পুুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাত ১২টা পর্যন্ত বৈঠক করেন। এরপর দলটি রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হোশি কুনিওর মরদেহ দেখেন এবং বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন। এ সময় রাজশাহী থেকে আসা মো. এনামের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের সিআইডির বিশেষজ্ঞ টিমও জাপানি দলের সঙ্গে ছিলেন। তারা নিহত হোশির কাপড়সহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন এবং লাশটি  পরখ করেন। এদিকে গতকাল রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ডা. হরেন্দ্রনাথ, ডা. সুলতানা ও ডা. রবি শংকর এবং জাপান দূতাবাসের চিকিৎসক কারসিয়া মাজিয়া ময়নাতদন্ত করেন। এরপর প্রতিনিধি দলটি রংপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জাকির হোসেন ও ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকদের সঙ্গে অধ্যক্ষের চেম্বারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এরপর কঠোর পুলিশি নিরাপত্তায় জাপানি প্রতিনিধি দলটি রংপুরের মাহিগঞ্জ সংলগ্ন কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি এলাকায় যেখানে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে গুলি করে হত্যা করা হয় ওই স্থান এবং জাপানি নাগরিকের ঘাসের প্রকল্পও পরিদর্শন করেন। তারা সেখানে বেশ কিছু সময় কাটান এবং প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। জাপানের নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাউনিয়া থানার ওসি রেজাউল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেছেন। এদিকে গতকাল পাঠানো রংপুরের এসপির প্রতিবেদনে জাপানি নাগরিক নিহতের পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানিয়েছেন, জাপানি নাগরিকের পূর্ণ নাম হোশিও কুনিও, পাসপোর্ট নং- টিকে ১২৫৯৫৫২, টাইপ- বি, ইস্যু ফর্ম জাপান। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, জাপানি নাগরিক ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০১১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর প্রথম বাংলাদেশে আসেন এবং রংপুর শহরে তার জনৈক বন্ধু গোলাম জাকারিয়া বালার বাসায় কিছু দিন থেকে পুনরায় দেশে ফিরে যান। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৭শে মে মাল্টিপল ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ায় তার বন্ধু গোলাম জাকারিয়া বালার বাসায় অবস্থান করেন। পাসপোর্ট অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৩১শে মে ১৯৪৯। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোলাম জাকারিয়া বালা, পিতা মৃত শাজাহান আলী, সাং- মুন্সীপাড়া, থানা- কোতোয়ালি, জেলা- রংপুর জাপান প্রবাসী ছিলেন। বর্তমানে তার ভাই জাকারিয়া জামিল মিলন, আক্তার জামিল মিশন ও শিপন সরকার শিপন ২০ বছর ধরে জাপানে বসবাস করছেন। মিলন, মিশন ও শিপনের সঙ্গে হোশি কুনিওর জাপানে পরিচয় হয়। পরিচয় সূত্রে হোশি কুনিও বাংলাদেশে এসে গোলাম জাকারিয়া বালার বাসায় একাকী অবস্থান করেন। এরপর জাপান প্রবাসী তার ভাই আক্তার জামিল মিশনের মাধ্যমে তার বন্ধু মো. হুমায়ুন কবির হিরার সঙ্গে হোশি কুনিওর পরিচয় হয় এবং সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর হুমায়ুন ও কুনিও মিলে দুই দশমিক ৮ একর জমি লিজ নিয়ে যৌথভাবে বিদেশী ঘাস চাষ শুরু করেন। প্রথম দিকে হিরার মোটরসাইকেলে করে প্রজেক্টে আসা যাওয়া করতেন। এরপর কয়েক দিন আগে মোন্নাফ নামে এক রিকশাচালককে আনা নেয়ার কাজে নিয়োজিত করা হয়। ঘটনার দিনে মো. মহিদুল ইসলামের বাড়ির সামনে দুই জন অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী জাপানিকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি করে। হোশি কুনিও’র বুকে, ডান কাঁধে ও ডান হাতের কব্জিতে গুলিবিদ্ধ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পিকআপযোগে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পরই তার ব্যবসায়িক বন্ধু হুমায়ুন কবির হিরা, রিকশাচালক মোন্নাফ, ঘটনাস্থল সংলগ্ন বসবাসকারী মো. মহিদুল ইসলাম ও বাড়িওয়ালা গোলাম জাকারিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এদিকে জাপানি নাগরিক হত্যা ঘটনার পর শনিবার রাতে রংপুর জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান লাকু, মহানগর বিএনপি নেতা রাশেদুন্নবী বিপ্লবকে সাদা পোশাকে পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে বলে পরিবার অভিযোগ করেছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। রংপুরের পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রংপুরের সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস ছালাম জানিয়েছেন হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারা পেয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করা যাবে না বলে তারা জানান।

No comments

Powered by Blogger.