বিমান টিকিটের টোপেই ‘বাঘিনি’ খাঁচায়

বাঘিনিকে খাঁচা-বন্দি করতে টোপ লাগে। আর উত্তর-পূর্বের ‘বাঘিনি’কে লোভ দেখিয়ে খাঁচায় টানতে দিল্লি-কলকাতা যাওয়া-আসার একজোড়া বিমান টিকিটকেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা।
কে এই বাঘিনি?
তিনি সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত মনোরঞ্জনা সিংহ। সিবিআইয়ের এক তদন্তকারীর কথায়, জেরায় সময় নিজেকে তিনি বাঘিনি বলেই জাহির করতেন। বলতেন, ‘‘আই অ্যাম টাইগ্রেস!’’
প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের সঙ্গে সাংবাদিক মনোরঞ্জনার বিয়ে হয়েছিল ১৯৯৫-এ। কিন্তু গোয়েন্দাদের কাছে তিনি দাবি করেছেন, স্বামীর অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ২০০৮-এ নিজের ছেলেকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এসেছিলেন তিনি। প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইও শুরু করেছেন।
সারদা কাণ্ডে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে গত এপ্রিল মাসে সিবিআইয়ের ডিরেক্টর অনিল সিন্হাকে সরাসরি চিঠি লিখেছিলেন মনোরঞ্জনা। চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আইন মেনেই তিনি ব্যবসা করেছেন। সিবিআই গোয়েন্দাদের কথায়, সারদার প্রায় ৪০ কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগে মনোরঞ্জনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সারদার ‘বেঙ্গল মিডিয়ার’ সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ওই টাকায় উত্তর-পূর্ব ভারতে ‘রাজধানী’ ও ‘ফ্রন্টিয়ার’ নামে টিভি ও রেডিও চ্যানেল শুরু হয়েছিল, চুক্তিপত্র অনুয়ায়ী যার চেক সই থেকে সংবাদ পরিবেশন— সব ক্ষমতাই ছিল মনোরঞ্জনার হাতে।
সিবিআইয়ের অভিযোগ, সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনকে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ করে সারদার পুঁজি দিয়েই মনোরঞ্জনা ব্যবসা করে মুনাফা করেছেন। গুয়াহাটিতে ‘রাজধানী’ ও ‘ফ্রন্টিয়ার’-এর অফিসে তল্লাশি চালিয়ে বহু নথি উদ্ধার করা হয়েছে, যা পরীক্ষা করে এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে দাবি সিবিআইয়ের। চুক্তিপত্র অনুযায়ী সারদার ‘বেঙ্গল মিডিয়া’র কাছ থেকে মাসে ১৫ লক্ষ টাকা করে বেতন নিতেন মনোরঞ্জনা। সঙ্গে বিলাসবহুল বাড়ি, চালক-সহ গাড়ি, অন্যান্য সুবিধা এবং ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক সফরের সব খরচ। সিবিআইয়ের ডিরেক্টরকে লেখা চিঠিতে মনোরঞ্জনা জানিয়েছেন, গুয়াহাটি বিমানবন্দরেই সারদা-কর্তার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। তার পরেই যৌথ ভাবে সংবাদ চ্যানেলের ব্যবসার পরিকল্পনা।
সিবিআইয়ের এক তদন্তকারীর কথায়, জেরার সময়ে গোয়েন্দাদের ঘোল খাইয়ে দিয়েছেন চতুরএই মহিলা। দিল্লিতে কংগ্রেস ও বিজেপির প্রথম সারির অনেক নেতার সঙ্গে মনোরঞ্জনার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় একাধিক বার তা উল্লেখ করে তদন্তকারীদের চাপে রাখার চেষ্টা করতেন তিনি। সেই সঙ্গে বারে বারে একটা কথাই বলতেন, ‘‘আমার সঙ্গে পাঙ্গা লড়তে আসবেন না। রিমেমবার— আই অ্যাম টাইগ্রেস!’’
সেই বাঘিনি এখন খাঁচাবন্দি। এবং তার জন্য কম ঘাম ঝরাতে হয়নি সিবিআইকে। এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, সব তথ্য যাচাই করে আদলতগ্রাহ্য প্রমাণ হাতে আসার পরই মনোরঞ্জনাকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করা হয়। বেশ কয়েক বার জিজ্ঞাসাবাদের পর মনোরঞ্জনা কিছুটা আন্দাজ করেছিলেন তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। তাই বার বার কালক্ষেপ করছিলেন। মনোরঞ্জনা দিল্লিতে থাকতেন। সেখান থেকে গ্রেফতার করতে কিছু
আইনগত সমস্যা ছিল সিবিআইয়ের। কয়েকটি নথিতে সইসাবুদ করার প্রয়োজনে ডাকা হচ্ছে বলে ফোনে তাঁকে জানানো হয়। পাশাপাশি দু’টি বিমানের টিকিটও তাঁর গুলমোহর পার্কের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একটি দিল্লি থেকে কলকাতা আসার, অন্যটি সে দিন বিকেলেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার। সিবিআইয়ের এক কর্তার যুক্তি, এর ফলে চতুর মনোরঞ্জনা ভাববেন, তাঁকে গ্রেফতারের কথা ভাবাই হচ্ছে না। আর ওই ফাঁদেই পা দেন তিনি। সকালের বিমানে কলকাতা এসে সরাসরি সিজিও কমপ্লেক্সে আসেন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা জেরার পরে বিকেলে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। দিল্লি ফেরার টিকিট তাঁর ব্যাগেই রয়ে যায়।
এক সিবিআই কর্তার কথায়, বাঘিনি এখনও খাঁচা-বন্দি। বর্তমান ঠিকানা জেল নয়, এসএসকেএম হাসপাতালের কেবিন। তিনি ‘অসুস্থ’। আত্মীয়দের সংস্রবে থাকতে চান বলে এখন আলিপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক সৌগত রায়চৌধুরীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন মনোরঞ্জনা। আদালত সূত্রে খবর, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোনও আত্মীয়কে তাঁর কাছে থাকার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন তিনি। তবে মনোরঞ্জনার শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল বলেই জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা

No comments

Powered by Blogger.