৪৪ বছর পর কবর খুঁজে পেলেন স্বজনরা

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর স্বজনরা খুঁজে পেলেন দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর। এঁরা হলেন তৎকালীন ইপিআরের ল্যান্স নায়েক মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং হাবিলদার মো. মিয়া হোসেন।
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দিনাজপুর-রংপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের দশমাইল মোড়ে সম্মুখ সমরে শহীদ হন তাঁরা।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার ছয় মাস পর তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর থেকে এই দুজনের পরিবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার সনদ, দুই হাজার টাকা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর করা একটি চিঠি পায়। কিন্তু পরিবারের কেউ জানতে পারেনি এই দুজনকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে বা আদৌ কবর দেওয়া হয়েছে কিনা। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর অবশেষে স্বজনেরা সন্ধান পেলেন এই দুই শহীদের কবর।
আজ শনিবার দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-রংপুর মহাসড়কের দশমাইল মোড় নামক স্থানে পরিবারের সদস্যরা এ দুজনের কবরের পাশে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর দুই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিহতদের কবরের সন্ধান দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিনিয়োগ বোর্ডের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মাহবুব কবির মিলন।
মাহবুব কবির মিলন বলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্ধান করেন। তেমনই একটি ইতিহাসের পেছনে ছুটতে গিয়ে তিনি এই দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবরের সন্ধান পান। জানতে পারেন দুই মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সন্ধান পায়নি কেউ। তিনি খোঁজখবর করে দেখেন দিনাজপুরের প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এবং দিনাজপুরের বিজিবি দপ্তরে এই দুই শহীদের ঠিকানার বিষয়ে কোনো রেকর্ড নেই। সম্প্রতি বিজিবির সদর দপ্তর পিলখানার রেকর্ড অফিস থেকে তাঁদের পারিবারিক ঠিকানা বের করা হয়। ল্যান্স নায়েক মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের উত্তর বাটমারা গ্রামে। বাবার নাম সফিউর রহমান। বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছেন। এক ভাই ও এক বোন বেঁচে আছেন। হাবিলদার মিয়া হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার খলিশাউর ইউনিয়নের গৌরকান্দা গ্রামে। মিয়া হোসেনের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে আছেন। পরে তিনি এই ঠিকানায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
মিলন বলেন, ‘পরিবারের কাছে কবরের খবর দিতেই তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রায় এক ঘণ্টা কাঁদেন তাঁরা। ওই মুহূর্তের কথা বলে বোঝাতে পারব না।’
আজ শনিবার সন্ধ্যায় দিনাজপুর দশমাইল মোড়ে দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে দিনাজপুর বিজিবি সেক্টর সদর দপ্তর এর ২ রাইফেল ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আখতার ইকবাল, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আবু রায়হান মিয়া, অন্যতম আয়োজক জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মো. সাখাওয়াত হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দিনাজপুর জেলা কমান্ডার সিদ্দিক গজনবী ও সাবেক কমান্ডার এম এ জলিলসহ বিশিষ্টজনরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা দুই শহীদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক মো. নাছির হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৬ মাস পর বিডিআর সদর দপ্তর থেকে বড় ভাই শহীদ হওয়ার সনদ, দুই হাজার টাকা এবং বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বাড়ির ঠিকানায় আসে। এরপর ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বাবা এবং বাবার মৃত্যুর পর ২০০২ সাল পর্যন্ত মা ছেলের পেনশনের টাকা পান। কিন্তু আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো ভাতা পাননি। তিনি বলেন, সেই সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে ছিল বিডিআরের দপ্তর। যুদ্ধের পরে তিনি ভাইয়ের খোঁজ নিয়েছেন। তাঁর ভাই শহীদ হয়েছেন শুধু সেটাই জানানো হয়েছে। কিন্তু কোথায় নিহত হয়েছেন, কীভাবে নিহত হয়েছেন, সেটা কেউ জানাতে পারেননি।
শহীদ হাবিলদার মো. মিয়া হোসেনের স্ত্রী মোসাম্মৎ শামসুন নাহার (৬৫), ছেলে মো. শাহজাহান মিয়া (৪৬), মেয়ে সুফিয়া খাতুন (৪৬), পূর্বধলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. নিজামুদ্দিনসহ পরিবারের সদস্যরা নেত্রকোনা জেলা থেকে দিনাজপুরে আসেন স্বজনের কবরের কাছে। মিয়া হোসেনের স্ত্রী বলেন, সে সময় মাত্র দু বছর ছিল চাকরির মেয়াদ। এর মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের এক মাস আগে তিনি শেষবার যখন বাড়ি থেকে দিনাজপুর যান তখন তাঁর ব্যাংকের ও চাকরি কাগজপত্র সব সঙ্গে নিয়ে যান। বলেছিলেন, ‘যাচ্ছি, দু বছর পর চাকরি শেষ হবে, তখন পেনশনের টাকা ও ব্যাংকের টাকা সব একসঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরব’। এরপর যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শেষে স্বামীর কোনো কিছুই আর তিনি জানতেন না। তৎকালীন জেলা প্রশাসক, থানা এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদে অনেক খোঁজ করেছেন। কেউ তাঁদের কোনো হদিস দিতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘তাঁর কবরে আমরা আসতে পারছি, ফাতেহা পাঠ করতে পারছি এটাই শান্তি’।
১৯৭১ সালের সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দিনাজপুর জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মো. সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নিহতদের সঙ্গে ওই দিন একসঙ্গে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনিও। তিনি বলেন, পাক হানাদার বাহিনীর নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর সেনাক্যাম্প থেকে দশমাইল মোড় হয়ে পাকিস্তানি পাক হানাদার বাহিনীর দিনাজপুরে প্রবেশের চেষ্টা করে। হানাদার বাহিনীর প্রবেশ রুখতে ইপিআর, মুজাহিদ, পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধা-জনতা দিনাজপুর-রংপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের দশমাইল মোড়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রচণ্ড লড়াই হয়। সেই সম্মুখ সমরে পাক হানাদার বাহিনীর একটি কামানের গোলায় নিহত হন দিনাজপুর কর্মরত তৎকালীন ইপিআর এর ল্যান্স নায়েক মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং হাবিলদার মো. মিয়া হোসেন। স্থানীয়রা দশমাইল মোড়ে মহাসড়কের পাশে তাঁদের কবর দেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে দিনাজপুর বিডিআরের উদ্যোগে কবর দুটি পাকা করা হয়। বাঁধানো কবরে তাঁদের নামফলকে ঠিকানা লেখা আছে-‘শহীদ হাবিলদার মিয়া হোসেন। বাড়ি ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ’। আর ‘ল্যান্স নায়েক মো. মোস্তাফিজুর রহমান। বাড়ি ঝালকাঠি-বরিশাল’। ‘শহীদ হন ১২-০৪-১৯৭১।’

No comments

Powered by Blogger.