মাটির নিচে গণতন্ত্র খুঁজছেন এরশাদ

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। ৯০-এর কাছাকাছি বয়সে তিনি এখনও প্রাণবন্ত। যদিও তিনি নিজে মনে করেন তার বয়স ৪০। প্রতিনিয়ত ছুটছেন এরশাদ। এখান থেকে সেখানে। ইতিহাস তাকে স্বৈরাচার বললেও কথিত গণতান্ত্রিক জমানায় তিনি রাজনীতি করছেন দাপটের সঙ্গেই। সবসময়ই তিনি লাইমলাইটে। যদিও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন তার জন্য কিছুটা হলেও ভাগ্যবিপর্যয় নিয়ে আসে। সেসময় হঠাৎ করেই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। পরে অবশ্য তাকে ‘আধুনিক কারাগারে ‘যেতে হয়। তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি চলে যায় নির্বাচনে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সরকার ও মন্ত্রিসভায়- দু’জায়গাতেই ঠাঁই পায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পান। মন্ত্রিসভায় জাপার থাকা না থাকা নিয়ে প্রতিদিনই শোনা যায় নতুন নতুন কথা। যদিও এরশাদের ছোটভাই সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদেরই হয়তো সত্যি কথাটি বলেছেন- জাপার মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ এরশাদ বা রওশনের হাতে নেই।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ ধরে রেখেই এরশাদ মাঝে মাঝে সরকারের সমালোচনা করেন। যদিও আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউই তার সমালোচনা থেকে বাদ যায় না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এরশাদ চিহ্নিত হয়েছেন অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে। তার নয় বছরের শাসনামলে গণতন্ত্র মুক্তির জন্য আন্দোলন হয়েছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতৃতেই। যে আন্দোলনে নূর হোসেন, ডা. মিলনসহ অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। সেই এরশাদ রোববার যশোরে জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলনে বলেছেন, গণতন্ত্র অনেক আগেই ১০০ হাত মাটির নিচে চলে গেছে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় এলে আবার গণতন্ত্র মুক্তি পাবে। এরশাদ মাটির নিচে যেমন গণতন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন তেমনি শেয়ালের গর্তে খুঁজে পেয়েছেন বিএনপিকে। বলেছেন, বিএনপি এখন শেয়ালের গর্তে। মাঝে-মধ্যে মাথা উঁচু করে বিবৃতি দিয়ে আবার ভয়ে লুকায়। আর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আপনারা জানেন। আমরাই একমাত্র দল। যারা মানুষের পাশে থেকে সব ভাল কাজ করছি। আমাকে মানুষ ভুলতে পারবে না। এখন আবার আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। সর্বশেষ গতকালও গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন এরশাদ। এদিন তিনি বলেছেন, সংবিধানের পাতায় গণতন্ত্র থাকলেও দেশে নেই। দখলবাজ ও টেন্ডারবাজদের দখলে চলে গেছে দেশ। সুশাসন নেই, সবার কাছে আছে বন্দুক-পিস্তল।
যার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নয় বছর আন্দোলন করেছে বাংলাদেশের জনগণ সেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গণতন্ত্র অনুসন্ধান অনেক পর্যবেক্ষকের মধ্যেই বিস্ময় তৈরি করেছে। তিনি আসলে কোন গণতন্ত্র খঁজছেন তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। এটা সত্য যে- এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশের মানুষ ভোটাধিকার ফিরে পেলেও গণতন্ত্রের বেশির ভাগ মৌল উপাদানই পাননি। ভোটাধিকার গণতন্ত্রের প্রধানতম উপাদান তবে একমাত্র উপাদান নয়। কেউ কেউ যখন গণতন্ত্র বনাম উন্নয়ন তত্ত্ব হাজির করছেন তখন এরশাদের গণতন্ত্র খোঁজা কৌতূহল উদ্দীপকতো বটেই। তবে তার এই অনুসন্ধান গণতন্ত্র মুক্তি আন্দোলনের শহীদদের আত্মাকে কতটা শান্তি দিতে পারবে সে প্রশ্ন রয়েই যাবে। আদৌ বাংলাদেশের গণতন্ত্র দেখে সেসব আত্মা শান্তি পেয়েছে কি-না সে প্রশ্নের সমাধানও অবশ্য এখনও হয়নি।
এরশাদ যখন গণতন্ত্র খুঁজছেন তখন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হায়দার আকবার খান রনো একটি সহযোগী দৈনিকে ‘গণতন্ত্রই রক্ষাকবচ’ শীর্ষক এক লেখায় অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের একটি বক্তব্যের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তার লেখা নতুন বই  ‘ফ্রম টু ইকোনমি টু টু নেশন: মাই জার্নি টু বাংলাদেশ’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন: ‘ওই সব দিনে ফিরে গেলে (অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে), এটা ভাবি, কিভাবে এসব কথা সেদিন বলতাম। এসব কথা বলার সময় ডান-বাম চিন্তা করতাম না।...কিন্তু এখন কোন  লেখা লিখতে গেলে এটি প্রকাশের আগে এক সপ্তাহ লেগে যায় এবং পাঁচবার পড়ে মত দেন রওনক (তাঁর স্ত্রী)। স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য সবার মতো আমাকে আজকাল প্রতিটি শব্দ নিয়ে ভাবতে হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসনের আমলে আমরা টেবিলে বসেই দুই ঘণ্টায় যে কোন কিছু লিখতে পারতাম।’
কয়দিন আগে অন্য একটি সভায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের এখন বাক স্বাধীনতা নেই। যদিও ঠাট্টাছলে এক বিশ্লেষক বলেন, বাক স্বাধীনতা না থাকলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এ কথা বলছেন কিভাবে?

No comments

Powered by Blogger.