ভালুকায় বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষ: আবারো দুই কোটি টাকার চামড়া যাচ্ছে জাপানে by আসাদুজ্জামান

ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হাতিবেড় গ্রামের রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড নামে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলা কুমির চাষ প্রকল্প থেকে দ্বিতীয়বারের মতো অক্টোবর-নভেম্বরে আবারো প্রায় দুই কোটি টাকার ৫০০ কুমিরের চামড়া রফতানি হচ্ছে জাপানে। এ দিকে ২২টি মা কুমির ডিম দিয়েছে এক হাজার ১০০টি এবং বাচ্চা ফোটানোর জন্য এসব ডিম ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। আর এ থেকে প্রায় ৬৫০টি বাচ্চা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কোম্পানির প থেকে জানা যায়, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড থেকে গত ২২ ডিসেম্বর জাপানের হরিউঁচি ট্্েরডিং কোম্পানি নামে একটি ট্যানারিতে ৪৩০টি কুমিরের চামড়া বাণিজ্যিকভাবে রফতানি করা হয়েছে; যার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ ছাড়া সংরক্ষিত কুমিরে মাংস, দাঁত ও হাড় রফতানির লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। কুমিরের মাংস শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করা হবে। জাপানিজ এ কোম্পানি তিন বছর ধরে এ ফার্মটি নিয়মিত পরিদর্শন করে। সর্বশেষ এ বছর হরিউঁচি ট্্েরডিং কোম্পানির লোকজন পাঁচবার ফার্ম পরিদর্শন করেন এবং তারা গত ২২ ডিসেম্বর ৪৩০টি কুমিরের চামড়া নিয়ে যান। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর ২০১০ সালের জার্মানির একটি ইউনিভার্সিটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ৬৭টি কুমির এক কোটি টাকা বিক্রি করে। এ ছাড়াও গত বছর অক্টোবরে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে উপহার হিসেবে পাঁচটি কুমির দেয়া হয়।
ভালুকা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাতিবেড় গ্রামে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড নামে ১৩ একর ৫৬ শতক জমি ক্রয় করে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ৭৪টি কুমির দিয়ে খামারটি শুরু করা হয়। মালয়েশিয়ার সারওয়াত থেকে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫টি কুমির আনা হয়। এর মধ্যে পর্যায়ক্রমে আটটি কুমির মারা যায়। পরে অবশিষ্ট কুমিরগুলো প্রকল্পের পুকুরে ছাড়া হয়। এসব কুমিরের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর ছিল। কুমিরগুলো ৭ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১২ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা। কুমিরের গড় আয়ু ১০০ বছর। আমদানিকৃত কুমিরের মধ্যে ১৫টি পুরুষ রয়েছে। প্রতি মাসে এদের ৩০০ কেজি মাংস খাবার হিসেবে দেয়া হতো। বন্য অবস্থায় ১০-১২ বছর বয়সে এবং ফার্মে ছয়-সাত বছর বয়সের একটি স্ত্রী কুমির বছরে একবার (এপ্রিল-মে) ৩০ থেকে ৪০টি করে ডিম দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৭০ থেকে ৮০ দিন। এখানে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফোটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে খামারে ৪০টি পুকুর রয়েছে। ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ার সারওয়াত কুমির ফার্ম থেকে দেড় কোটি টাকার বিনিময়ে আরো ৪০টি ব্রিডার কুমির ক্রয় করে আনা হয়। সব মিলিয়ে এ খামারে ১০০টি ব্রিডার কুমির রয়েছে। এ ছাড়াও এ খামারের নিজস্ব উৎপাদিত ছোট-বড় মিলে ১২ শতাধিক কুমির রয়েছে যেগুলোর দৈর্ঘ্য ৫ ফুট থেকে সাড়ে ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা।
কুমিরের কোনো কিছুই ‘ফেলনা’ নয় বলে চামড়া, মাংস, দাঁত ও হাড় বিপণন করা যায়। চীন, জাপান, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কুমিরের ৭০ থেকে ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যমানের মাংসের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, ব্যাংকক, ভিয়েতনাম, সিংগাপুর, পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ প্রায় অর্ধশত দেশে কুমিরের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে।
কুমির বাণিজ্যিকভাবে রফতানির ল্েয লালন-পালন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘কুমিরবেড়’। এশিয়ায় সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ‘কুমিরচাষ’ করা হয়। এটি বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড’-এর একটি প্রকল্প। এ ছাড়া ৫০টি কুমির দিয়ে গত বছর আকিজ গ্রুপ বান্দরবানের নাই্যংছড়িতে কুমিরের আরেকটি বাণিজ্যিক খামার শুরু করেছে। ওই কুমিরগুলোও মালয়েশিয়ার সারওয়াত খামার থেকে আনা।
এখানে উল্লেখ্য, প্রায় এক দশক আগে ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের জামিরদিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ল্েয বেরসরকারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আজরা প্রোডাক্টড লিমিটেড নামে একটি গুইসাপের খামার গড়ে তোলা হলেও বছর ঘুরে আসতে না আসতেই গুইসাপের প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
ফার্ম ম্যানেজার আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ জানান, বর্তমানে ২২টি মা কুমির প্রায় ৫০টি করে ডিম দিয়েছে। এই হিসাবে কুমিরগুলো এক হাজার ১০০টি ডিম দিয়েছে এবং এসব ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। আর এ থেকে প্রায় ৬৫০টি বাচ্চা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তা ছাড়া এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আরো চার-পাঁচটি মা কুমিরের ডিম দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরো জানান, ২০১৪ সাল থেকে কুমির প্রজনন ও উৎপাদনের স্বার্থে সেখানে দর্শণার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে জনপ্রতি ২৫০ টাকা ফি’র বিনিময়ে পরিদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতে দর্শনার্থীদের জন্য আলাদাভাবে নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে কুমির দেখানোর পরিকল্পনা রয়েছে প্রকল্পটির।
রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজিব সোম জানান, অক্টোবর-নভেম্বরে ৫০০ কুমিরের চামড়া রফতানি করা হচ্ছে এবং এসব কুমিরের মাংস চীন, জাপান ও কোরিয়ায় রফতানি করার জন্য প্রক্রিয়া চলছে। এতে আরো কয়েক কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। তা ছাড়া এখন থেকে প্রতি বছর প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার কুমিরের চামড়া ও মাংস রফতানি করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.