বন্ধ পাটকল চালু করা মারাত্মক ভুল! by আবুল হাসনাত

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পাট খাতকে লাভজনক করার অঙ্গীকার করেছিল। তারপর পাঁচটি বন্ধ পাটকল চালু করে সরকার। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই উদ্বোধন করেছিলেন খুলনায় খালিশপুর জুট মিলস। এরপর ২০১৪ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ জানায়, পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। আর এর দেড় বছরের মাথায় অর্থমন্ত্রী বললেন, বিলুপ্ত পাটকলগুলো পুনরায় চালু করা ছিল সরকারের মারাত্মক ভুল।
সরকারের ভাষ্য, পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটলেও সরকারি পাটকল নিজের অর্থে চলতে পারছে না। পুনরুজ্জীবনের নামে সরকারি পাটকলে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া ৩৫ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ২২ হাজারই প্রয়োজনের অতিরিক্ত। ফলে বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে পাট কেনা পর্যন্ত প্রায় সব কাজেই বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনকে (বিজেএমসি) হাত পাততে হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এখন আর নতুন করে অর্থ দিতে রাজি নন।
বিজেএমসির পক্ষে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে টাকা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল ঈদুল ফিতরের আগে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ এ বিষয়ে সারসংক্ষেপ তৈরি করে অর্থমন্ত্রীকে দেন। ওই সারসংক্ষেপে নিজের হাতে অর্থমন্ত্রী লিখেছেন, ‘সরকার বিলুপ্ত পাটকলগুলো পুনরায় চালু করে মারাত্মক ভুল করেছে বলে আমার মনে হয়। ব্যক্তিমালিকানা খাতে পাট পুনরুজ্জীবিত হয় এবং তারা বেশ ভালোই করছিল। সরকারি মিল চালু করার পর থেকেই পুরো পাট খাতের অবস্থা দিন দিন খারাপই হচ্ছে। সরকারি পরিচালনার দুর্বলতাই এর জন্য দায়ী। এই ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন না করে টাকা প্রদান শুধু লোকসানের বোঝা ভারী করবে। পাট মন্ত্রণালয়কে এভাবেই জানাতে হবে। প্রয়োজনে চিঠি আমিই লিখতে পারি।’
পাট খাতকে উজ্জীবিত করতে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত বিজেএমসিকে ৫ হাজার ৪৪১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা দিয়েছে। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পাট মন্ত্রণালয়/বিজেএমসির সই হওয়া সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ভবিষ্যতে বিজেএমসির জন্য আর কোনো সরকারি অর্থ বরাদ্দ চাইতে পারবে না পাট মন্ত্রণালয়/বিজেএমসি।
পাট খাতের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে সরকার ২০১১ সালে বিজেএমসিকে প্রথম ১০৫ কোটি টাকা দিয়েছিল। এর পুরোটাই চলে যায় দুটি বন্ধ পাটকল চালু করতে। এগুলো হলো সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস (সাবেক কওমী জুট মিলস) ও খুলনার খালিশপুর জুট মিলস (সাবেক পিপলস জুট মিলস)। বিজেএমসি নিজস্ব অর্থায়নে ৭২ কোটি ৫০ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও তিনটি বন্ধ পাটকল চালু করে। এগুলো হলো চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় কর্ণফুলী জুট মিলস ও ফোরাম-কর্ণফুলী কার্পেটস ফ্যাক্টরি এবং খুলনার দৌলতপুর জুট মিলস।
বিজেএমসি বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে সরকারি পাটকলে নতুন করে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ২২ হাজারই প্রয়োজনের অতিরিক্ত। এই শ্রমিকদের জন্য বিজেএমসির বছরে খরচ হচ্ছে ২৫০ কোটি টাকা। আবার কাঁচা পাটের অভাবে উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমেছে। বছরের অধিকাংশ সময়ই মাত্র ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ তাঁত চালানো সম্ভব হয়েছে। কারণ, অর্থসংকটের কারণে গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ শতাংশ পাট কিনতে পেরেছে সংস্থাটি।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে খানিকটা একমত ২০১০ সালে সরকারের গঠিত পাট কমিশনের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্ধ পাটকল পুনরায় চালু করা ভুল হয়েছে, তা আমি সরাসরি বলব না। কারণ, আমরা পাট কমিশনের প্রতিবেদন তৈরির সময় দেখেছিলাম, এর চাহিদা আছে। কিন্তু দক্ষ ব্যবস্থাপনা না থাকলে তো বাজার ধরা যাবে না। এসব পাটকল চালানোর জন্য দক্ষ লোক পাওয়া যায়নি। অন্য লোক দিয়ে চালাতে হয়েছে। সে কারণেই সমস্যা হয়েছে। তবে যেহেতু সরকার যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবে পাটকলগুলো দাঁড়ায়নি; তাই এক অর্থে বলা যায়, ভুল ছিল।’
এসব বিষয়ে বিজেএমসির চেয়ারম্যান হুমায়ূন খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী আমাদের পাটের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম ছিল পাটশিল্প পুনরুজ্জীবিত করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একের পর এক বন্ধ পাটকল চালু করেছেন। অন্যান্য বন্ধ কলকারখানা চালু করার বিষয়ে ওনার নির্দেশনাও আছে। এই অবস্থায় উনি (অর্থমন্ত্রী) কীভাবে বলেন যে বন্ধ পাটকল চালু করে ভুল হয়েছে।’
বিজেএমসি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়: ঈদের আগে পাট মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিজেএমসির জন্য ১ হাজার ২০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থ বিভাগ তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে চরম হতাশা ও উত্তেজনা চলছে। যেকোনো সময় পাটকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে পাট মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ও উৎসব ভাতা দিতে ২০০ কোটি এবং পাট কিনতে ৫০০ কোটি মোট ৭০০ কোটি টাকা জরুরি ভিত্তিতে বরাদ্দ দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই সারসংক্ষেপটি তৈরি করেন অর্থসচিব। তাতে বলা হয়, ২০০৯ সালে সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিজেএমসিকে লাভজনকভাবে পরিচালনার জন্য পাট মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসি একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার বিজেএমসির যাবতীয় দায়দেনা (বকেয়া মজুরি-বেতন-স্টোর বিল ও যাবতীয় ঋণ) পরিশোধ করতে ৫ হাজার ২৪১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা দেয়। এই আর্থিক সহায়তা দিলে ভবিষ্যতে বিজেএমসির জন্য আর কোনো সরকারি আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হবে না এবং আরও কয়েকটি শর্তে পাট মন্ত্রণালয়/বিজেএমসি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়।
সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়, এরপরও বিজেএমসিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তিন দফায় ২০০ কোটি দেওয়া হয়। ফলে বিজেএমসিকে দেওয়া মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪৪১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
অর্থসচিবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বিজেএমসির কাঁচা পাট কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। সার্বিক দিক বিবেচনা করে ‘অনুন্নয়ন খাতের নগদ ঋণ’ খাত থেকে পাট কেনার জন্য এ বছর ১০০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তা নাকচ করে দেন। যদিও পরে ওই অর্থ দেওয়া হয়েছে। এরপরেও ৬ আগস্ট পাট কেনার জন্য ৪০০ কোটি টাকা চেয়ে আবারও চিঠি দিয়েছে বিজেএমসি।

No comments

Powered by Blogger.