বিনা ভোটে ৩০০ আসনেও নির্বাচন? by মিজানুর রহমান খান

আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে আমাদের সংসদের সামনে বিবেচনাধীন কোনো বিষয় নেই। কিন্তু সেই শূন্যতা কিছুটা হলেও পূরণ করে রেখেছেন আমাদের সুপ্রিম কোর্ট। এই মুহূর্তে উচ্চ আদালতের দেওয়া তিনটি ফর্মুলা জাতির সামনে বিবেচনাধীন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের রায় সূত্রে আমরা সর্বদলসম্মত রাজনীতিককে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী করতে পারি। আবার ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সংসদে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে মন্ত্রী সংখ্যা (লটারিতে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ভাগ) বণ্টন কিংবা মেয়াদ শেষের এক বছর বিরোধী দলকে শাসন করতে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে পারি।
এটা ভেবে আশ্বস্ত ও সন্তুষ্ট হতে পারলে খুশি হওয়া যেত যে আমাদের জাতীয় সংসদ এই তিনটি ফর্মুলার আলোকে খুব দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেবে। সেটা যে আপাতত অবাস্তব, আইনমন্ত্রী হাইকোর্টের এখতিয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তা স্পষ্ট করেছেন। কিন্তু এর মধ্যেও যে বিষয়টি স্বস্তিদায়ক, সেটা হলো, সরকারের নির্বাচনবিমুখ অবস্থান শুধু তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিই নাকচ করছে না। আদালতও করছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখ ভার করে রেখেছে। জাতিসংঘের অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোও হাল ছাড়েননি। তারানকো বাংলাদেশ সফরে আসার আগ্রহ ব্যক্ত করে চলেছেন। অন্তত এটুকু জানি যে গত জুন বা জুলাইয়ের কোনো এক সময় তিনি টেলিফোন করেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। সৈয়দ আশরাফ তাঁকে নাকি যুক্তি দেন যে খামোখা এসে কী করবেন। খেলোয়াড়দের মধ্যে আপস না হলে কী করে খেলা হবে?
যদি ধরে নিই যে ২০১৯ সালেই নির্বাচনী খেলাটা হবে। তাহলে সেটা কি ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের চেয়ে কম ত্রুটিমুক্ত হবে? আমজনতা হিসেবে আমরা তেমনটা যে অনুমান করে নেব, তার ভিত্তি কী? সরকারি দল ও নির্বাচন কমিশন কি একতরফাভাবে এমন কিছু করছে, যাতে আমরা বুঝতে পারি যে আসন্ন নির্বাচন আগের চেয়ে কম ত্রুটিপূর্ণ হবে।
এর আগে সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণকে আমরা নির্দয়ভাবে অগ্রাহ্য করতে দেখেছি। এবার তাঁরা হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দেবেন, তা কি মনে করার কোনো কারণ আছে? বরং এই রায় আরেকটি ভয় ধরিয়েছে। বিনা ভোটে নির্বাচন বৈধ ও সংবিধানসম্মত বলে আগামী নির্বাচনেও কি বিপুলসংখ্যক আসনে মানুষ ভোট দেখবে না? কত আসনে বিনা ভোটে প্রার্থীরা পাস করবেন—১০০, ২০০ নাকি ৩০০ আসনেই?
আমরা ছয় বছর ধরে এটাই দেখে আসছি যে সরকারি দল অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালতের সেসব সিদ্ধান্ত বরণ করে নিয়েছে, যা তাদের পছন্দ হয়েছে। তারা হাইকোর্টের দেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলা নিয়ে সংসদে আলোচনা করবে না। কিন্তু ১৫৩ জনের সপক্ষে যে ‘বৈধতার’ সিল পড়েছে, তাকে তারা স্বাগত জানাবে।
হাইকোর্টের সামনে প্রশ্ন নেওয়া হয়েছিল যে ১৫৩ জন, যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের সংসদ সদস্য পদ বৈধ কি না? হাইকোর্ট বলেছেন, বৈধ। এর মানে ‘আইনগতভাবে’ বৈধ। কিন্তু তা রাজনৈতিকভাবে কতটুকু বৈধ? জনগণ এই নির্বাচনকে ভালোভাবে নেয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে ভোটাররা তাদের ভোট দিতে পারেননি। ‘আইনগত’ যুক্তি দিয়ে, আদালতের রায় দেখিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ করা যাবে না। তাঁরা তাঁদের ভোটের অধিকার না পাওয়ার জন্য বিলাপ করবেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের ন্যূনতম শর্ত পূরণ হয়েছে বিনা ভোটে। এটা একটা টেকনিক্যালি বৈধ সরকার। এটা দেখার বিষয় যে ১৪৭ আসনে ভোট হয়েছে এবং এই প্রার্থীরা বিনা ভোটে পাস করেননি। ১৫৩ আসনের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন বিনা ভোটে। একটি সরকার গঠনের ন্যূনতম আসন হলো ১৫১। এ জন্য তাদের মানুষের ভোটের দরকার হয়নি। ১৫৩ আসনে ভোট না লাগলে ৩০০ আসনে কেন লাগবে? যদি ৩০০ আসনেই একজন করে প্রার্থী থাকে এবং তার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, সমঝোতা না হলে এবং কোনো কারণে বিএনপি আরও বেশি হতাশ ও দুর্বল কিংবা অবরোধের মতো আরও ভয়ংকর কোনো সহিংস কর্মসূচি দিতে উদ্যত হওয়া—এর মধ্যে যাই হোক না কেন—তাতে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ থাকবে না। সরকারি দল ও ‘সরকারি বিরোধী দলের’ প্রার্থী কারা ও কেন হবেন, তা প্রতিটি আসনের শান্তিপ্রিয় মানুষের অজানা থাকবে না। আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর সুনজরের বাইরে কেউ সহজে যাবেন না।
তবে এখন ভোট ছাড়াই নির্বাচিত ১৫৩ জন সাংসদ যদি মনে করেন যে হাইকোর্টের রায় তাঁদের পক্ষে গেছে বলেই তাঁরা বৈধতার সিল পেয়েছেন, তাহলে তা ঠিক হবে না। তাঁরা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাবেন। তাঁরা মহান সংসদের আঙিনায় বাকি ১৪৭ জনের তুলনায় অনেক বেশি জোরালো অনুপ্রবেশকারী। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারায় বলা আছে, কোনো আসনে একাধিক প্রার্থী না থাকলে সেখানে ভোট লাগবে না। একমাত্র প্রার্থী বিনা ভোটে পাস করবেন। হাইকোর্ট বলেছেন, এই বিধানটি ছিল বলেই ভয়ংকর সাংবিধানিক বিপর্যয় এড়ানো গেছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে এই বিধান আছে। কিন্তু হয়তো তাদের কারও ইতিহাসে এই বিধানের গণ-অপব্যবহার নেই। একটি-দুটি আসনে এমনটা হতেই পারে। সব সংবিধানে সাংসদের পদত্যাগের বিধান থাকে। কিন্তু তা কী ১৪৭ জনের গণপদত্যাগের জন্য? এই উদাহরণ আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করেছে ১৯৯৪ সালে। স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী গণপদত্যাগকে অসাংবিধানিক বলে সঠিক রায় দিয়েছিলেন। ওই একই চেতনায় ১৫৩ জনের নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। আইনপ্রণেতারা ১৯ ধারাটার এমন পাইকারি অপব্যবহার কল্পনা করেননি। এর এমন ব্যবহার ঘটেছে, যা সংবিধানকেই অকার্যকর করে দেয়।
অন্তত এই বিষয়গুলোতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেও এই রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল হতে পারে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে পাস করানোর ঘটনা সংবিধানের ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচনের’ মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠনের বিধানকেই শুধু নষ্ট করেনি। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন’কে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের অন্তর্গত চেতনাকেও নষ্ট করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ‘প্রত্যক্ষ ভোটে’ নির্বাচিতদের আস্থাভাজন হিসেবে নন, বরং দালিলিকভাবে বিনা ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। হাইকোর্ট রায়ে ১৫৩ জনকে বৈধ বললেও তাঁরা এটাও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বলেছেন, নির্বাচন ছাড়া আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কল্পনা করা চলে না। আর নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায়’ হতে হবে।
অনেকেই ধরে নিতে পারেন আদালত প্রকারান্তরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকেই ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন। প্রশ্ন হলো, আদালতের পর্যবেক্ষণ (অবিটার ডিকটা) কি খুবই তুচ্ছ? এটা সংসদ বিবেচনা করতে পারে কি না? যাঁরা আদালতের নতুন দুই ফর্মুলার অস্বাভাবিকতা নিয়ে বিচলিত, তাঁদের বলব, আপনারা প্রধানত চেতনাটা ধারণ করুন, ধরনটা নয়। আদালত একটি মাইলফলক রায় দিয়েছেন, কারণ যে নির্বাচন ব্যবস্থা গোটা সংবিধানকেই তছনছ করে দেয়, সেখানে তাঁরা নীরব দর্শক হতে পারেন না। আদালত তঁার সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত যে দেননি, তা–ও নয়।
রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ (সংসদ, সরকার ও আদালত) ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতির ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। জনকণ্ঠ-এর মামলায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন, ‘আমাদের সংবিধান এক চমৎকার নিয়ন্ত্রিত সংবিধান।’ আবার বিচারপতি মোস্তাফা কামালও যথার্থই বলেছেন যে ‘যে যার গণ্ডির মধ্যে থাকবেন ঠিকই। কিন্তু কখনো এমন পরিস্থিতি আসবে যখন “ওভারল্যাপিং” ঘটবে।’ এর মানে একটি অঙ্গ অন্য কোনো অঙ্গের উঠোনে প্রবেশ করবে।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বর্তমান দশম সংসদ ও ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার ফর্মুলা দেন। তাঁর রায় প্রদানের মাত্র চার বছরের ব্যবধানে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহান্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ কি পুনরায় সংসদের উঠোনে প্রবেশ করলেন?
যদি তাঁরা তা করেও থাকেন, তাহলেও তাঁরা ঠিক করেছেন বলেই মনে করি। তাঁরা এমন কিছুই করেননি, যা আমাদের উপমহাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে অনুসরণ করা হয় না। এই দুটি রায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে আমাদের রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ নামের স্তম্ভটি গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রশ্নে মৌলিকভাবে সংসদ ও নির্বাচন কমিশন থেকে পৃথক অবস্থান নিয়েছেন। এ রকম ফর্মুলা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দেওয়ার কথা। কিন্তু আগেই বলেছি, তারা বাস্তবে নির্বাচনবিরোধী একটি ব্যুরোতে নিজেদের নামিয়ে এনেছে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘আদালতের পর্যবেক্ষণের কোনো কার্যকরতা নেই।’ সতর্ক আদালতও তা-ই বলেছেন, এটা পর্যবেক্ষণ। এর কোনো বাধ্যবাধকতার ব্যাপার নেই। তবে এটা পুনর্বার লিখে রাখতে চাই, সর্বোচ্চ আদালতের অবিটার ডিকটা মানার বাধ্যবাধকতা আছে, যদিও এই মতের পক্ষে আমি দেশের শীর্ষ সাংবিধানিক আইনজীবীদের প্রকাশ্য সমর্থন পাইনি। ব্রিটিশ ভারতে দেওয়া এলাহাবাদ হাইকোর্টের একটি রায়ের বরাতে লিখেছিলাম, বিচারপতি খায়রুল হকের দেওয়া ওই অবিটার বাধ্যতামূলক। কারণ, তিনি সর্বোচ্চ আদালত থেকে দিয়েছেন। সেই অবিটার অগ্রাহ্য করার কারণেও বর্তমান সংসদের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। হাইকোর্টের অবিটার ঐচ্ছিক, তবে তাঁদের অবিটার আপিল বিভাগের অবিটারকে সমুন্নত করেছে। ধারণা করা যায়, আপিল বিভাগে গেলে দুই ফর্মুলা তাঁরা মুছবেন না, পরিমার্জন করতে পারেন। তবে কালক্ষেপণ না করে তিন ফর্মুলা একত্রে সরকার ও সংসদের বিবেচনায় নেওয়া উত্তম। এই যুক্তির সমর্থনে সাম্প্রতিক তথ্য দিই।
২০১৩ সালের ১৮ জুলাই ভারতের প্রধান বিচারপতি আলতামাশ কবীরের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ মত দেন, ‘বিচারপতি বি পি সিনহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ এর আগে (২০ মার্চ, ১৯৫৯) বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের অবিটার ডিকটা বা পর্যবেক্ষণের উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আজও তা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করি। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদের (আমাদের ১১১) আওতায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া অবিটার ডিকটা মানার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে।’
আমাদের আপিল বিভাগ যে আশঙ্কায় ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে দুই মেয়াদে নির্বাচন না করতে পর্যবেক্ষণ বা ‘অবিটার’ দিয়েছিলেন, তা ইতিমধ্যে সত্যে পরিণত হয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.