গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবিলম্বে খুঁজে বের করার তাগিদ জাতিসংঘের

গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবিলম্বে খুঁজে বের করার জন্য বৈশ্বিক নীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। সময় নষ্ট না করে এখনই তা করার তাগিদ দিয়েছেন তারা। এক্ষেত্রে গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজন, প্রত্যক্ষদর্শী, আইনি সহায়তাকারী, অনুসন্ধানে জড়িতদের নিরাপত্তা দিতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আজ ইন্টারন্যাশনাল ডে অব দ্য ভিকটিমস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স (আন্তর্জাতিক গুম দিবস) উপলক্ষে এমন আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দুটি গ্রুপ। তার একটি হলো কমিটি অন এনফোর্ডস ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস। অন্যটি দ্য ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস। ওদিকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটে এশিয়ায়। এ বিষয়ে জাতিসংঘে রিপোর্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। উদাহরণস্বরূপ তাতে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের নূরুল আমিনের নাম। এশিয়ার দেশগুলোতে গুমের পরিসংখ্যান এ রকম- শ্রীলঙ্কায় ৫৬৭৬, ভারতে ৩৫৩, পূর্ব তিমুরে ৪২৮, ফিলিপাইনে ৬২৫, থাইল্যান্ডে ৭১, ইন্দোনেশিয়ায় ১৬৩, কম্বোডিয়ায় ১, লাওসে ২, মিয়ানমারে ২, পাকিস্তানে ৯৯, বাংলাদেশে ২৯, নেপালে ৪৫৮, কাশ্মীরে ৮০০০+, উত্তর কোরিয়ায় ২০, চীনে ৩০। আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে এ তথ্য দিয়েছে এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস (এএফএডি)। ওদিকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে খসড়া চুক্তি করা সহ পদ্ধতিগতভাবে সব রকম ব্যবস্থা নিতে সরকারসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কমিটি অন এনফোর্ডস ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস ও দ্য ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস। জেনেভা থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত দু’বছরে সারাবিশ্বে মোট ২৪৬টি গুমের ঘটনা নিয়ে তারা কাজ করেছে। এতে পরিষ্কার ধারণা মেলে যে, এই বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের চর্চা অনেকগুলো দেশেই চলছে। হাজার হাজার এ রকম ঘটনার মধ্যে এ সংখ্যা সামান্যই। বাকি ঘটনাগুলোর কথা প্রতিশোধ ও নিরাপত্তার ভীতির কারণে কখনও রিপোর্ট করা হয় না। গুমের এ রকম অনেক ঘটনা কখনোই জাতিসংঘের কাছে রিপোর্ট করা হয় নি। এর কারণ, মানবসম্পদের ঘাটতি। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির বিদ্যমান যে মানগুলো রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতি। ওয়ার্কিং গ্রুপ ও দ্য কমিটি অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস গত এক বছর ধরে যেসব জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে দেখা গেছে, নিখোঁজ হওয়া ১৩ জনকে বন্দি অবস্থায় জীবিত পাওয়া গেছে। মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে দু’জনকে। জাতিসংঘের এ দুটি গ্রুপের গৃহীত পদক্ষেপে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনুভূতিতে পার্থক্য এসেছে। তাদের একজনের প্রতিক্রিয়া- আপনাদের অব্যাহত হস্তক্ষেপ ও পরিস্থিতিতে নজর রাখার জন্য অপহরণকারীরা অমুককে মুক্তি দিয়েছে। ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমাদের নেই। এ গ্রুপের প্রতিটি সদস্যের প্রতি আমি যে ঋণী সে বার্তা পৌঁছে দিতে অনুরোধ করছি। পুত্র গুম হয়েছেন- এমন এক মায়ের আকুতি- আমার বার্তাটি পড়ে আপনারা আমলে নিয়েছেন এ জন্য ধন্যবাদ। শেষ পর্যন্ত কেউ আমাদের কথা শুনছেন ও আমার সন্তানের বিষয়ে মনোযোগী হয়েছেন এ জন্য আমি অভিভূত। আপনাদের অফিস এক্ষেত্রে যে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছে, উদ্বেগ দেখিয়েছে, তাতে নিরাপদে মুক্তি পেয়েছে অমুক। সন্তান গুম হয়েছেন দু’জন মায়ের। এমন দুই মা যৌথভাবে লিখেছেন- মাত্র দু’সপ্তাহ আগে কমিটি অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস-এর চিঠি পেয়েছেন তারা। এর দু’একদিনের মাথায় সরকার আমাদের কাছে এসে তদন্ত করার কথা বলে এবং সেই তদন্তে আমাদেরকে থাকতে বলে। এতগুলো মাস পরে এতেই প্রথম আমরা একটু স্বস্তি পেয়েছি  যে, আমাদের সন্তানদের খোঁজার জন্য আবার কাজ হচ্ছে। কমিটি এবং ওয়ার্কিং গ্রুপ জরুরি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তাতে দেখা যায়, গুম করে দেয়ার ক্ষেত্রে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুমের পর যত ঘণ্টা বা দিন পার হবে ততই গুম হওয়া ব্যক্তিকে জীবিত ফিরে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। গুমের অব্যবহিত পরেই এক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপকে অবহেলায় ফেলে রাখা যাবে না। উল্টো পদ্ধতিগতভাবে খসড়া বা নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে, গুম হওয়া ব্যক্তিকে যেকোন উপায়ে উদ্ধারে পদক্ষেপ নেয়া হয় অবিলম্বে। গুম হওয়া ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য গৃহীত এসব নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সব দেশে। এক্ষেত্রে কোন দেশে কতগুলো গুম হয়েছে তার ওপর নির্ভর করা যাবে না। এমনভাবে এটা করতে হবে যাতে, গুম হওয়া ব্যক্তিকে অবশ্যই জীবিত উদ্ধার করা যায়। গুমের ঘটনা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে কমিটি ও ওয়ার্কিং গ্রুপ। গুম হওয়া ব্যক্তির কোন রকম ক্ষতি হওয়ার আগে তাকে উদ্ধারে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণেরও আহ্বান জানায় ওই বিশেষজ্ঞ দু’গ্রুপ। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যে বা যারা গুম হওয়ার বিষয়ে রিপোর্ট করবেন, প্রত্যক্ষদর্শী, গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজন, তাদের আইনি সহায়তাকারী, অনুসন্ধানে জড়িত সব পক্ষের প্রতি প্রতিশোধ নেয়া থেকে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমানভাবে আমরা সব সরকারের কাছে আহ্বান জানাই। যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাদের পক্ষে যারা কাজ করছেন, তাদের ক্ষেত্রে ওয়ার্কিং গ্রুপ ও কমিটি অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেসের ক্রিয়া পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য আমরা উৎসাহিত করছি। বিবৃতির নোটে বলা হয়েছে, গত এক বছরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার জরুরি সহায়তা চেয়েছে এমন ঘটনার ১৫১টি জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেছে ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অ্যান্ড ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস। একই সময়ে কমিটি অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ১০৩টি আবেদন পেয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত ঘটনা ৯৫টি। এ নিয়ে মোট নিবন্ধিত গুমের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৬। এসব ঘটনা ঘটেছে সেসব দেশে যারা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস-এ স্বাক্ষরকারী।
ওদিকে এএফএডি এক বিবৃতিতে বলেছে, ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এএফএডি। জাতিসংঘ ২০১১ সালে আজকের এ দিনকে আন্তর্জাতিক গুম দিবস ঘোষণা করে। এশিয়া ও বিশ্বজুড়ে এখন কয়েক হাজার মানুষ গুমের শিকার। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এএফএডি। গুম হওয়া ব্যক্তি, তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি এএফএডি বিভিন্নভাবে তাদের প্রতি দৃঢ়তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে। এক্ষেত্রে আলোচিত নামগুলোর কথা সামনে চলে আসে। যেমন, বাংলাদেশে নূরুল আমিন, নেপালে সুবর্ণ পাউডেল, জমমু-কাশ্মীরে মুসতাক আহমেদ খান, থাইল্যান্ডে সোমচাই নীলাফাইজিট, ইন্দোনেশিয়ায় উইজি থুকুল, দক্ষিণ কোরিয়ায় হোয়াং ওন, শ্রীলঙ্কায় প্রগীত একনালিগোড়া। বলা হয়েছে এমন নাম অসংখ্য। প্রতিটি গুমের শিকার ব্যক্তির রয়েছে একটি নাম, একটি জীবন ও একটি পরিবার। গুম হওয়া ব্যক্তিরা নীরব হয়ে যান নি। তাদেরকে জোর করে গুম করে দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘনের নাম হলো জোর করে গুম করে দেয়া। গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবার উভয়েই নানা ভাবে অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন। জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্ডস অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস ১০৬তম অধিবেশনে ৩০টি দেশের ৪০০ গুমের ঘটনা পরীক্ষা করেছে। এতে বলা হয়েছে, এশিয়ায় গুমের ঘটনা বিপুল পরিমাণে হলেও মাত্র চারটি দেশ জাপান, কাজাখস্তান, ইরাক ও কম্বোডিয়া অনুমোদন করেছে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস (কনভেনশন) অনুমোদন করেছে। পুনরায় তাই এএফএডি এশিয়ার সব দেশের প্রতি কনভেনশন অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস অনুমোদন দিতে ও গুমকে অভ্যন্তরীণ আইনে অপরাধ হিসেবে পরিগণিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
ফিরছে না গুম হওয়া মানুষেরা
স্টাফ রিপোর্টার জানায়, দিনের পর দিন, মাস পেরিয়ে বছর কেটে যাচ্ছে। তবু ফিরছে না গুমের শিকার হওয়া মানুষেরা। প্রিয় স্বজনকে ফিরে পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন অনেকেই। কিন্তু কোন আশার আলো দেখতে পাননি তারা। তবু গুম হওয়া মানুষের স্বজনদের কেউ কেউ এখনও আশায় বুক বেঁধে আছেন। এখনও ভাবছেন গুম হওয়া স্বজন একদিন ঠিকই ফিরে আসবেন। যদিও গুম হওয়া মানুষদের উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোন তৎপরতা নেই। গুমের ঘটনায় যেসব সাধারণ ডায়েরি বা মামলা দায়ের হয়েছে সেগুলোর তদন্ত চাপা পড়ে আছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব মতে, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত অন্তত ৪ শতাধিক মানুষ গুম হয়েছেন। এদের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। গুমের শিকার হওয়া এসব মানুষের মধ্যে অল্প কয়েকজন ফিরে এসেছেন। আর লাশ উদ্ধার হয়েছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির। বাকি প্রায় তিন শতাধিক ব্যক্তি এখনও গুম হয়ে আছেন। পরিবারের সদস্যরা জানতে পারছেন না, তাদের স্বজনেরা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছেন। তাদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার কারণে গুম হওয়া এসব মানুষের বিষয়ে কোন খোঁজ করছে না পুলিশ-র‌্যাব।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘আমাদের দেশে কোন গুমের ঘটনা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন গুমের সঙ্গে জড়িতও নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে ধরলে তাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করে।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে পারিবারিক, ব্যবসায়ীক ও রাজনৈতিক কারণে অনেকেই আত্মগোপন করে থাকেন। এগুলো কোনভাবেই গুম বলা যাবে না।’ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যমতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তারা (মানবাধিকার সংগঠন) তো কত কিছুই বলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুমের সঙ্গে জড়িত নয়। কেউ গুম বা অপহরণ হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের খুঁজে বের করে।’
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৩৭৫ জন মানুষ গুমের শিকার হন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ৬৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আসকের তথ্য মতে, ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সালের গুমের শিকার হন ২১ জন। ২০১০ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৭-এ। এরপর বছর বছর ধরে গুমের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। আসকের তথ্য বলছে, ২০১১ সালে গুমের শিকার হয়েছেন ৫৯ জন, ২০১২ সালে ৫৬ জন, ২০১৩ সালে ৬৮ জন ও ২০১৪ সালে ৮৮ জন। আর চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ৩৬ জন। এর মধ্যে ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গুম হওয়ার পর দুজন ছাড়া পেয়েছেন আর ৩ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ২১০ জন গুমের শিকার হয়েছেন। যাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে গুমের শিকার হয়েছেন ৩ জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ২৬ জন, ২০১৩ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ৩৯ জন ও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে ৪০ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও বরাবরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা অস্বীকার করে আসছেন। কিন্তু গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোন উদ্যোগও দেখা যায় না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় গেলে পুলিশ মামলা বা জিডি নিতেই অনীহা প্রকাশ করতো। আবার কোনভাবে জিডি দায়ের করা গেলেও সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় শব্দ বাদ দিতে হতো। কিন্তু এভাবে জিডি নেয়ার পরও গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল রাতে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি ইলিয়াছ আলীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বনানী এলাকা থেকে তুলে নেয়া হয়। এ ঘটনার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ইলিয়াছ আলীর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তিনি বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন তাও জানতে পারছে না পরিবারের সদস্যরা। ইলিয়াছ আলীর নিখোঁজের বিষয়টি দেখভাল করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ। কিন্তু ডিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় বলার মতো কোন তথ্য নেই।
চলতি বছরের ১০ই মার্চ উত্তরার বাসা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরিবারের সদস্যরা জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে একদল লোক তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর প্রায় ২ মাস নিখোঁজ থাকার পর গত ১১ই মে ভারতের শিলং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, চোখ বাঁধা অবস্থায় কে বা কারা তাকে শিলংয়ে ফেলে গেছে তা তিনি বুঝতে পারেননি। এ ঘটনায়ও সালাহউদ্দিন কিভাবে শিলংয়ে গেলেন বা প্রকৃতই তাকে কেউ অপহরণ করেছিলো কিনা সেই রহস্যও উদ্ঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, এখনও প্রায় ৩শ মানুষ নিখোঁজ হয়ে আছেন। এদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা তো করছেই না; বরং এসব নিয়ে যারা কথা বলছে বা ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হয়রানি, সমালোচনা বা ক্ষতি করার চেষ্টা চলছে। নূর খান বলেন, গুমের ঘটনায় থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে চাইলে থানা অভিযোগই নিতে চায় না। এটা আসলে সামগ্রিকভাবে সরকারের ব্যর্থতা বা গুম হওয়া লোকজনকে খুঁজে বের করতে এক ধরনের অনীহা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ মানবাধিকারকর্মী বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে গুমের ঘটনাগুলোর প্রকৃত কারণ জানা হোক। কিন্তু এত বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও রাষ্ট্রের কোন গুরুত্ব নেই যা দুঃখজনক।
‘স্বজনদের আশা তারা ফিরে আসবেন’
রাজধানীর পৃথক স্থান থেকে গুম হওয়া ৮ পরিবারের সদস্যরা আশায় বুক বেঁধে আছেন। তারা আবার পরিবারের মাঝে ফিরে এসে সংসারের হাল ধরে পরিবারের সচ্ছলতা আনবেন। তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া ৮ জনকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। এতে আশান্বিত হয়েছে ওই ৮ পরিবার।
গুম হওয়া তেজগাঁও থানাধীন ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি জানান, প্রায় ১৯ মাস আগে শাহিনবাগের ৫৫৩ নম্বর বাড়ি থেকে র‌্যাব-১ পরিচয়ে তার ভাইকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বিএনপির রাজনীতি করা ছাড়া তার কোন অপরাধ ছিল না। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা আটকের বিষয়টি তো স্বীকার করেনি। বরং উল্টো হুমকি-ধমকি দিয়েছে। কোন জিডি ও মামলা নেয়া হয়নি। তিনি আরও জানান, গুম হওয়ার পর থেকে হতাশা নেমে এসেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে এলেও ওই আবেদনে তাদের কোন টনক নড়েনি। বরং বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বিভিন্ন সময় ওই সংস্থা সমন্ধে কটূক্তি করেছে। তার ভাই এ দেশের নাগরিক ছিল। অপরাধ করে থাকলে আইনের মাধ্যমে তার বিচার করা হোক।
গুম হওয়া মাজহারুল ইসলাম রাসেলের বোন লাবনি জানান, ২০১৩ সালে ৪ঠা ডিসেম্বর বারিধারা এলাকা থেকে তার ভাইকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে নিখোঁজ আছে রাসেল। এই বুঝি রাসেল পরিবারের মাঝে ফিরে আসলো। ভাইয়ের দুশ্চিন্তায় আমার বাবা ও মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দুদিন আগে জাতিসংঘ তার ভাইকে উদ্ধার করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। রাসেল উত্তর নাখালপাড়ার ১০ নম্বর রোডের ৪৯৯ নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। গুম হওয়ার আসাদুজ্জামান রানার বোন মিনারা বেগম জানান, প্রায় ১৯ মাস আগে তার ভাইকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কোন অপরাধ ছিল না। নিখোঁজের পর থেকে আমরা সরকারের কাছে দাবি করে আসছি তাকে ফিরিয়ে দেয়া হোক।

No comments

Powered by Blogger.