অনন্ত হত্যা- ফেরিওয়ালা সেজে বাসা চিনেছিল খুনিরা? ...দেয়ালে ‘অনন্তকাল’

লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ রিপন হত্যা
সিলেটে লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যার ২১ থেকে ২৫ দিন আগে খুনিরা মুঠোফোনে তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এমনকি হুমকিদাতারা ফেরিওয়ালা সেজে অনন্তর বাসা ও আশপাশের রাস্তা-গলি সম্পর্কে ধারণা নিয়েছিল। আর এসব খবর জানতেন অনন্ত নিজেই। তবে অসুস্থ বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করে সে খবর অনন্ত তাঁর পরিবারের সদস্যদের জানাননি। তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, পুলিশও এখন এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে। গতকাল রোববার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিলেট মহানগরের বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নুরুল আলম জানান, অনন্তর মুঠোফোনের কললিস্ট পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি স্পর্শকাতর। তাড়াহুড়া না করে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। ফেরিওয়ালা সেজে বাসা ও আশপাশের গলি চেনার বিষয়টি ফোনে হুমকি দেওয়ার সময় হুমকিদাতারাই জানায় অনন্তকে গত দুই দিনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় অনন্তর তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর। তাঁরা জানান, ফেরিওয়ালা সেজে বাসা ও আশপাশের গলি চেনার বিষয়টি ফোনে হুমকি দেওয়ার সময় হুমকিদাতারাই জানিয়েছিল অনন্তকে। হত্যাকাণ্ডের ২০ থেকে ২৫ দিন আগে বাসা পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকতে পারে।
সিলেটে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ গতকাল বিকেলে নগরের
শহীদ মিনার থেকে ‘আমিই অনন্ত’ শীর্ষক প্রতিবাদী মিছিল
বের করে। পরিষদের কর্মীরা নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের
মুখাবয়বের ছবি পরে মিছিলে যোগ দেন l ছবি: প্রথম আলো
অনন্তের এক বন্ধু বলেন, ‘হুমকির বিষয়টি অনন্ত আমাদের বললেও তাঁর মধ্যে তেমন উদ্বেগ ছিল না। অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলার ফাঁকেই হুমকির কথা আমাদের জানিয়েছিল সে। হুমকি-ধমকি নিজে সয়ে পরিবারকে নিরুদ্বেগ রাখার চেষ্টা দেখা যেত অনন্তের চোখে-মুখে।’
আরেক বন্ধু জানান, হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে অনন্ত বলতেন, ‘ধুৎ, কিচ্ছু হবে না... হুমকি দিয়ে আসলে কেউ কিছু করতে পারে না...।’
অনন্তর বড় বোনের স্বামী আইনজীবী সমরবিজয় শেখর বলেন, ‘হুমকির বিষয়টি অনন্ত পরিবারের সদস্যদের কাছে চেপে গেছে। মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরেছি। পুলিশ দ্রুত খুনিদের গ্রেপ্তার করুক, এটাই আমরা চাই।’
মুঠোফোন কোম্পানির কাছ থেকে মুঠোফোনের এক মাসের তথ্য চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সমন্বয় করা সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মো. রহমত উল্লাহ। গতকাল তিনি বলেন, ‘অনন্তর কিছু খুদে বার্তায় তাঁর হুমকি পাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। খুনিরা তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছে, এটি বিভিন্ন সময়ে সে তার বন্ধুবান্ধবকে বলেছে। কারা এসব হুমকি দিয়েছে, সেটা এখন আমরা খতিয়ে দেখছি।’
গত মঙ্গলবার সকালে কর্মস্থলে যেতে বাসা থেকে বের হয়ে সিলেট নগরের সুবিদবাজারের নূরানী আবাসিক এলাকার চৌরাস্তা মোড়ে পৌঁছালে অনন্তকে কুপিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী চার দুর্বৃত্ত।
কর্মসূচি: অনন্ত হত্যার প্রতিবাদে সিলেটের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগে গতকাল বেলা পাঁচটায় নগরের কোর্ট পয়েন্টে মানববন্ধন ও প্রতিবাদী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
বিকেল চারটায় সম্মিলিত নাট্য পরিষদ ‘আমিই অনন্ত’ নামে মিছিল করেছে। অনন্তের ছবিসংবলিত ব্যানার হাতে নিয়ে নিজের মুখে অনন্তর মুখাবয়বের প্রতিকৃতি লাগিয়ে নগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে কোর্ট পয়েন্ট পর্যন্ত মিছিল করে নাট্য পরিষদ। পরে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের মানববন্ধনে একাত্ম হয় মিছিলটি।
দেয়ালে ‘অনন্তকাল’
লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার স্থানটির পাশের দেয়ালে
‘অনন্তকাল’ শিরোনামে এই চিত্রটি (ইনসেটে) অঙ্কন করা হচ্ছে।
আজ সোমবার এটি উন্মোচন করা হবে l ছবি: প্রথম আলো
সেই চৌরাস্তার মোড়টি দেয়ালঘেঁষা। সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকায় পিটিআইর দেয়ালের পাশটাই ঘটনাস্থল। সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নূরানী আবাসিক এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে গত মঙ্গলবার সকালে আক্রান্ত হয়েছিলেন বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ (৩২)। মুখোশধারী চার দুর্বৃত্ত অনন্তকে কুপিয়ে লাশ ফেলে গিয়েছিল সেখানে। সেই থেকে চৌরাস্তার মোড় পরিণত হয় দর্শনার্থী মানুষের পুঞ্জীভূত শোক আর ক্ষোভ প্রকাশের একটি স্থানে। অনন্তর রক্ত ছিটকে পড়েছিল দেয়ালেও। ঘটনার পর থেকে হত্যার স্থানটি পলিথিন দিয়ে ঢাকা। পরদিন বুধবার এলাকাবাসীর উদ্যোগে ওই স্থানে হয় মানববন্ধন। সেটি ছিল এলাকাবাসীর প্রথম প্রতিবাদ। এবার অনন্তের রক্তে রঞ্জিত দেয়ালের ওই অংশ স্থায়ী প্রতিবাদ হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। নিকষ কালো জমিনের ওপর ছোপ ছোপ রক্ত, তাতে সাদা অক্ষরে লেখা—‘জ্ঞানের জ্যোতি ছড়াবে অনন্ত/অনন্তকাল।’ অন্য পাশে অনন্তর লেখা থেকে কথা আর কলমযোদ্ধার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের চিত্র। এ যেন দেয়ালে ‘অনন্তকাল’।
গতকাল বিকেলে নূরানী আবাসিক এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকটা ছাপচিত্রের মতো করে দেয়ালে ‘অনন্তকাল’ অঙ্কন চলছে। এ চিত্রের নির্দেশক সিলেটের নাট্য ও সংস্কৃতি সংগঠন নগরনাট সভাপতি অরূপ দাশ। ‘ওইখানে আমিও আছি/যেখানে সূর্যোদয়, প্রিয় স্বদেশ পাল্টে দেব/তুমি আর আমি বোধ হয়...’ অনন্তের লেখা থেকে এ ছন্দকথা তিনিই চয়ন করেছেন। অরূপ জানান, অনন্তের শুভানুধ্যায়ী ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এটি হচ্ছে। গতকাল বিকেল থেকে দেয়ালের এ কাজ শুরু হয়েছে। আজ সোমবার দুপুরে সেটি উন্মোচন করা হবে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্ম বিভাগ থেকে পাস করে পূবালী ব্যাংকের সুনামগঞ্জের জাউয়াবাজার শাখায় ‘ডেভেলপমেন্ট অফিসার’ পদে কর্মরত ছিলেন।
লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার স্থানটির পাশের দেয়ালে
‘অনন্তকাল’ শিরোনামে এই চিত্রটি (ইনসেটে) অঙ্কন করা হচ্ছে।
আজ সোমবার এটি উন্মোচন করা হবে l ছবি: প্রথম আলো
অনন্ত মুক্তমনা ও সামহয়্যার ইন ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। পাশাপাশি তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও সক্রিয় ছিলেন। সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চেরও একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বিভিন্ন সময় বস্তুবাদ ও যুক্তিবাদ নিয়ে ব্লগে লিখতেন। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে পার্থিব (শুদ্ধস্বর, ২০১১, সহলেখক সৈকত চৌধুরী), সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেস্কো অধ্যায় (শুদ্ধস্বর, ২০১২), ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা (অবসর, ২০১১) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক ছোটকাগজ যুক্তি নামে একটি পত্রিকা নিয়মিত সম্পাদনা করতেন। হত্যাকাণ্ডের পর এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রথম মানববন্ধন হয়েছিল ‘অনন্ত হারানোর নয়...’ ব্যানারে। উদ্যোক্তাদের একজন নূরানী সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাহিন সিদ্দিকী দেয়ালে ‘অনন্তকাল’ অঙ্কনকে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সাদরে গ্রহণ করেন। শাহিন বলেন, ‘আমরা মানববন্ধনের দিনও দাবি করেছিলাম, ঘটনাস্থলে অনন্তের স্মৃতি রক্ষায় কোনো স্মারক বা স্তম্ভ হোক। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকেও আমরা জানিয়েছি।’ দেয়ালের এই অঙ্কন দেখে যেন সিটি করপোরেশন উদ্যোগী হয়—এ আহ্বান তাঁর।

No comments

Powered by Blogger.