গণমাধ্যমের স্বাধীনতা- তথ্যমন্ত্রীর দাবি ও চলমান বাস্তবতা by রোবায়েত ফেরদৌস

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর দাবি: ‘বাংলাদেশের সাংবাদিক ও গণমাধ্যম পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে...রাজনীতি ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বিভিন্ন সমস্যা থাকতে পারে, ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে; কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার বিগত ছয় বছরেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, ক্রমাগত এর সম্প্রসারণ ও বিকাশ সাধন করেছে। এ পর্যন্ত এমন কোনো আইন তৈরি করা হয়নি, যেটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকোচন করে কিংবা একজন পেশাদার সাংবাদিকের কর্মের স্বাধীনতাকে খর্ব করে’—তথ্যমন্ত্রী এমনটাই মনে করেন। (প্রথম আলো, ৪ মে ২০১৫)
তথ্যমন্ত্রীর দাবি সত্য হলে আমরা সবাই খুশি হতাম; কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ধরা যাক সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনের কথা। সেদিন সরকার-সমর্থকেরা সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অন্তত আটজন সাংবাদিকের ওপর শারীরিক আক্রমণ হয়েছে; তাঁদের মোবাইল ফোন, পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে; কোথাও সাংবাদিকদের আটকে রাখা হয়েছে; ভয় দেখিয়ে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে কমপক্ষে ১৫ জন সাংবাদিককে; একজন অনলাইন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধও হয়েছেন; পুলিশও কিছু কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দিয়েছে। এসব তথ্য তথ্যমন্ত্রীর দাবির বিপরীত। এ ছাড়া জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ সম্প্রতি জেলা সংবাদদাতাদের ওপর পুলিশ, রাজনীতিক ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের হুমকি-ধমকি-নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে।
গণমাধ্যম গণতন্ত্রের সহায়ক, কোনো সরকার একে প্রতিপক্ষ ভাবলে তা হবে গণতন্ত্র, জনগণের তথ্য জানা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় যেদিন ওপরের ওই দাবি তুলেছেন, ওই দিনের পত্রিকায়ই বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকের স্বাধীনতা নিয়ে আর্টিকেল-১৯ ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন ইন বাংলাদেশ-২০১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনের খবর আসে, যেখানে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে (প্রথম আলো, ৪ মে, শেষ পৃষ্ঠা)। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এই হার হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর প্রায় ২৩ শতাংশ নির্যাতনই হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরে সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে ১১ শতাংশ আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ৬৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সাংবাদিকদের হয়রানির পরিমাণ বেড়েছে ১০৬ শতাংশ। হয়রানির মধ্যে মানহানির দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাও রয়েছে।
২০১৩ সালে হয়রানির ঘটনা ছিল ৩৩টি; ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮টিতে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১০টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। ২০১৪ সালে মোট ২১৩ জন সাংবাদিক ও আটজন ব্লগার বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে চারজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গুরুতর জখম হয়েছেন ৪০ জন। আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬২ জন সাংবাদিক। সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিক নেতাসহ ১৩ জন মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে আদালত অবমাননার অভিযোগের মুখোমুখি করা হয়েছে। গত বছর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঘটা সহিংস ঘটনার একটিরও বিচার বা শাস্তি হয়নি। মাত্র পাঁচটি ঘটনার তদন্ত শেষ করা হয়েছে। ২৭ শতাংশ ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়াধীন। প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর ২০১৪ সালের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বৈশ্বিক সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬। ভারত, ভুটান, নেপাল ও মালদ্বীপের অবস্থানও আমাদের ওপরে!
এই হচ্ছে বাস্তবতা! তথ্যমন্ত্রীর দাবি এবং ওপরের বাস্তবতাগুলো মিলিয়ে নিলেই দেখা যায়, বাংলাদেশে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন। প্রকৃত প্রস্তাবে আইনের অস্পষ্টতা ও দুর্বলতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাংবাদিক ও অনলাইনের কর্মীদের হয়রানির সুযোগ পায়। যেমন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় সুস্পষ্টভাবে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অনলাইনে নির্দোষ প্রচারণার কারণেও সাংবাদিক ও অনলাইন লেখকেরা আইনি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিচারহীনতার কারণে রাষ্ট্রযন্ত্র, এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা অনেক সময় সহিংসতা ও আক্রমণের ঘটনা ঘটান। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত আক্রমণ, সহিংস ঘটনার তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি বর্তমানে গণমাধ্যমের কর্মীদের জন্য চরম বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ কারণে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য কার্যকর সুরক্ষা কৌশল ও নীতিমালা করা দরকার; পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, মানহানি ও আদালত অবমাননাসংক্রান্ত আইনকে মত প্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করাও জরুরি।
গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেন দরকার? একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি। লাতিন প্রবাদ বলছে, জনগণের কণ্ঠস্বরই ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর। গণতন্ত্রেরই অন্যতম অনুষঙ্গ তাই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কোনো রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। অনেকটা সংসদে বিরোধী দলের অবস্থানের মতো, তারা সংসদে সরকারের কাজের সমালোচনা বা বিরোধিতা করবে, তারা যেন সংসদে তা সুষ্ঠুভাবে করতে পারে, সেই সুযোগ সরকারি দলকেই নিশ্চিত করতে হবে।
‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি’—ভলতেয়ারের এই উক্তিই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৌল চেতনা। এই চেতনার চর্চার ভেতরেই লুক্কায়িত থাকে গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা। গণমাধ্যম নাগরিকদের বহুমুখিন যোগাযোগের পাটাতনটি তৈরি করে দেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানে যেহেতু খোলা সমাজ, তাই মানুষকে এখানে বহু স্তরে, বহু পর্যায়ে, বহু ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করতে হয়। গণমাধ্যম মানুষের জন্য তথ্য পাওয়ার বৃহত্তর সুযোগ তৈরি করে দেয়। সরকারকে চোখে চোখে রাখার মধ্য দিয়ে ‘গণতন্ত্রের প্রহরী’র ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম পাবলিক ডিবেট উসকে দেয়, পলিসি এজেন্ডা নির্ধারণ করে, নাগরিক মতামতের ফোরাম তৈরি করে, যেখানে জনগণ রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে তাদের ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। দুর্নীতির ওপর সার্চলাইট ফেলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। অজ্ঞতা ও ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি না করে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞাত হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে। সচেতন ভোটাররা তখন খারাপ শাসককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারেন। গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত জনপরিসর বাড়িয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সেতু গড়ে।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.