নরক যন্ত্রণা এখনও কুরে খায় রেজাউল, হাকিমকে

নরক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে প্রতিকূল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছেছেন বাংলাদেশের রেজাউল (১৮), মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হাকিম (২৭)। তারা মালয়েশিয়ায় স্থিতি হয়েছেন কিছুদিন আগে। কিন্তু এখনও কুঁড়ে খাচ্ছে সেই যন্ত্রণা। রেজাউল বলেছেন, তাদের যে নৌযানে করে পাচার করা হয়েছে তাতে গাদাগাদি করে ছিলেন ৯০০ মানুষ। এসব মানুষ তিন মাস ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছেন বন্দিশিবিরে। সেখানে তাদের আটকে রেখে জনপ্রতি ৯০০০ রিঙ্গিত মুক্তিপণ দাবি করা হয়। রেজাউল বলেন, সেখানে তাদের রড দিয়ে প্রহার করা হয়েছে। রাত ১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গহীন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। এ সময় খাদ্য তো দূরের কথা, পানি পর্যন্ত দেয়া হয় না। এখন রেজাউল থিতু হয়েছেন মালয়েশিয়ায়। সেখানে ওয়েটার হিসেবে কাজ করছেন। তবে যে বেতন পান তাতে পেট চলে না। তার ওপর আছে পুলিশি ঝামেলা। মাঝেমাঝেই পুলিশকে টাকা দিতে হয় তিনিসহ তার মতো অন্যদের। তার পরও রেজাউল খুশি। তার ভাষায়, দেশে তো কাজই নেই। তবে মালয়েশিয়াতে যারা বৈধভাবে প্রবেশ করেছেন তারাও খুব ভাল নেই। আরেক বাংলাদেশী রাশেদ (২৪)। তিনি একটি রেস্তোরাঁয় কাজের ভিসার জন্য এক এজেন্টকে দিয়েছেন ১৫ হাজার রিঙ্গিত। কিন্তু তাকে কাজ দেয়া হয়েছে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। রাশেদ বলেন, আমাকে যারা নিয়োগ দিয়েছেন তারা আমার পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছে। ফলে আমাকে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তাছাড়া ভিসার সঙ্গে কাজের সামঞ্জস্য না থাকায়ও তারা জেরা করে। এমনই অনেক সমস্যায় রয়েছেন মালয়েশিয়ায় বৈধ অথবা অবৈধভাবে যাওয়া বাংলাদেশীরা। গতকাল মালয়েশিয়ার দ্য স্টার পত্রিকার অনলাইনে তুলে ধরা হয়েছে অভিবাসীদের এসব দুর্ভোগের কথা। তাতে রোহিঙ্গা হাকিমের আর্তনাদ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হাকিম দুই বছর আগে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন নৌকাযোগে অবৈধভাবে। এখন পরিবারের অন্য সদস্যরাও তার মতো মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিতে গিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পুশব্যাকের শিকার হয়ে গভীর সমুদ্রে আটকা পড়েছেন। তাদের জন্য আর্তনাদ করছেন হাকিম। তিনি বলছেন, আমাকে আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিন। তারা গভীর সমুদ্রে আটকে আছে। তাদের কাছে খাবার নেই। পানি নেই। ফলে খুব তাড়াতাড়িই তারা মৃত্যুমুখে পতিত হবে। হাকিম বলেছেন, তার স্বজনরা যে বোটে রয়েছেন তাতে আরোহী আছেন ৩০০। তার এক আত্মীয় ফোনে জানিয়েছেন এরই মধ্যে ওই বোটের ২৮ জন মারা গেছে। দ্য স্টার ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে স্বজনদের যে ফোন নম্বর দিয়েছেন হাকিম, সেই নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। হাকিম বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানকালে দালালরা আমাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। সেখানে গেলে আমি ভাল চাকরি পাব। স্ত্রী ও তিন সন্তানকে টাকা পাঠাতে পারবো। এ জন্য জনপ্রতি দালালদের দিতে হয়েছে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার রিঙ্গিত। হাকিম তার সমুদ্র যাত্রার ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, আমাদের বহনকারী জাহাজে যখন আরোহীদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়লো, তারা জীবিত থাকা অবস্থায়ই সমুদ্রের পানিতে ফেলে দেয়া হয় তাদেরকে। একইভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন নেপালের নিরাপত্তা প্রহরী জঙ্গা বাহাদুর (৪৫)। তিনি কোন সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াই দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে প্রতিদিন পান ৫০ রিঙ্গিত। তবে তিনি ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছেন। তিনি বলেন, এখনও পুলিশ তার কাছ থেকে টাকা নেয়। তার সহকর্মীদের কাছ থেকে টাকা নেয়। নিয়োগকারীরা মাসে বিদ্যুৎ, পানির বিল ও বাসা ভাড়া বাবদ কেটে রাখে ১০ রিঙ্গিত। যেখানে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে মানুষে গাদাগাদি। এক সারি ঘরে তাদের ৮০ জনকে রাখা হয়েছে। সেখানে টয়লেটগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। লাইন দিতে হয় গোসল করতে হয়। ১৬ বছর বয়সী রোহিঙ্গা সালাউদ্দিন আরও ১৩ জনের সঙ্গে ঘুমান ২.৪ মিটার চওড়া ও ৬ মিটার লম্বা একটি শিপিং কন্টেইনারে। সেটা একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের পাশেই। গোসল করতে হয় উন্মুক্ত স্থানে। অব্যাহতভাবে থাকে না বিদ্যুৎ। তার মতে, তার রাজ্য রাখাইন প্রদেশের চেয়েও মালয়েশিয়ায় ভাল আছেন।
খাবার নিয়ে মারামারি ছুরি মেরে হত্যা, ফাঁসি
যাত্রাপথের লোমহর্ষক সব ঘটনার বর্ণনা দিলেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে অবৈধ পথে নৌকায় করে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে পৌঁছা অভিবাসীরা। তারা বললেন, খাবার নিয়ে তাদের নৌকাতেই দাঙ্গা বেধে যায়। এতে অন্তত ১০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের কাউকে কাউকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে। কাউকে গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কাউকে কাউকে নৌকা থেকে সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। বিবিসি’র কাছে এমন বর্ণনা দিয়েছেন অভিবাসীদের কয়েকজন। বিবিসি’র সংবাদদাতারা ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের একটি শিবিরে আশ্রয় পাওয়া অভিবাসীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবার গল্পই মোটামুটি একই রকম। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূল ছেড়ে যাওয়ার পর বার বার তাদের নৌযান বদল করা হয়েছে গভীর সমুদ্রে। বলা হয়েছে, তাদেরকে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে। একসময় তাদেরকে গভীর সমুদ্রের মধ্যে খাদ্য ও পানির তীব্র অভাবের মধ্যে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। আচেহর একটি শিবিরে আশ্রয় পাওয়া কয়েক শ’ লোকের মধ্যে একজন মোহাম্মদ রফিক। তিনি বলেন, তাদেরকে যেখানে ফেলে যাওয়া হয়েছে, সেখান থেকে মালয়েশিয়ার উপকূল আরও ছয় ঘণ্টার পথ। তিনি বর্ণনা করছিলেন, নৌযানের মধ্যে খাদ্য ও পানির তীব্র অভাবের মধ্যে বেপরোয়া মানুষদের সংঘর্ষ ও অনেককে সাগরে ফেলে দেয়ার কথা। তিনি বলেন, অন্তত ১০৪ জন লোক এভাবে মারা গেছে। রফিকের ভাষ্য, আমাদের তারা নৌকার উপর মারধর করেছে। মার সহ্য করতে না পেরে আমরা পানিতে নেমে যাই। পানিতে নামার পর যারা সাঁতার জানতো তারা পানিতে ভেসে ছিল। যারা জানতো না, তারা ডুবে মরে গেছে। ১০৪ জনের মতো মারা গেছে। বেশ কিছু ছোটো ছেলেমেয়েকে আমরা পাচ্ছি না। ঘটনাটা চলেছে রাত ৯টা পর্যন্ত। এরপর ৬ ঘণ্টা আমরা পানিতে ভেসে ছিলাম। এরপর ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী ও অনেক দূর পর্যন্ত মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা আমাদেরকে তুলে নেয়। আমরা এখন ইন্দোনেশিয়াতে আছি।
এদের অনেকেই বলেছেন, নৌকার ওপর অনেককে ছুরি মারা হয়েছে। কয়েকজনকে ফাঁসিও দেয়া হয়েছে। তবে এসব অভিযোগের সত্যতা নিরূপণ করা খুবই কঠিন। কিন্তু অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমেও এ ঘটনাগুলোর কথা যেভাবে রিপোর্ট হয়েছে, তার বর্ণনার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। আচেহ শিবিরে আশ্রয় পাওয়া আরেকজন হচ্ছেন মাদারীপুরের নজরুল। তিনি সাগরের মধ্যে নৌকার ওপরে সেই ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনাগুলোর কথা বর্ণনা করেন। বলেন, জাহাজে যখন আমরা পানি পাচ্ছিলাম না, প্রস্রাব করে পানি খেয়েছি। তারপরও আমাদের ওরা পানি দেয়নি। ওদের ট্যাঙ্কিতে দুই হাজার লোকের জন্য যথেষ্ট পানি ছিল। তবুও বার্মিজ, ওরা আমাদের পানি দেয় নি। তখন আমরা তাদের উত্ত্যক্ত করি। এভাবে মারামারি করার পর আমাদের বহু লোক ওরা মেরে ফেলে। কেটে কেটে সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। ভাসিয়ে দেয়ার পর আমরা চিৎকার করে সবাই একজোট হয়ে ওদের সঙ্গে লড়ি। ওদের মারতে মারতে আমরা পানিতে ফেলে দেই। ওরা আবার আমাদের গরম পানিতে মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে মারতে থাকে। তবুও আমরা ওদের সঙ্গে লড়াই করি। এক পর্যায়ে আমরা উপায়ন্তর না দেখে পানিতে লাফিয়ে পড়ি। এরপর একটি মাছ ধরার নৌকা আমাদের বাঁচায়। বাঁচিয়ে তারা আমাদের ইন্দোনেশিয়া আনে।
বিবিসি জানিয়েছে, তারা এ ঘটনাটি অন্য কোন সূত্র থেকে নিশ্চিত হতে পারে নি। কিন্তু আচেহর শিবিরে আশ্রয় নেয়া আরও অনেকের সঙ্গেই বিবিসির সংবাদদাতাদের কথা হয়েছে। যাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা মোটামুটি একরকম। মাত্র কয়েকদিন আগেই বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সুনামগঞ্জের মোহাম্মদ কায়েস। তিনিও এখন আছেন আচেহ প্রদেশের শিবিরে। তিনি নিজেও নৌকার ওপর সেই মারামারির কথা বিবিসিকে বলেন। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কাছাকাছি সমুদ্রে অনেকগুলো নৌকায় এখনও ভাসছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে যাওয়া কয়েক হাজার লোক।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূলের কাছে কয়েক ডজন নৌকায় হাজার হাজার অভিবাসী সাগরে ভাসছে। খাবার ও পানির তীব্র সংকট চলছে ওইসব নৌকায়। অনেকগুলো নৌকা থেকেই পাচারকারীরা পালিয়ে গেছে। এ সংকট নিয়ে ব্যাংককে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কর্মরত এনজিওদের একটি সম্মেলনে আলোচনা চলছে। সেখানে যোগ দিয়েছেন হারুনার রশীদ। তিনি অভিবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে কর্মরত মালয়েশিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ক্যারাম এশিয়া’র সমন্বয়কারী। অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে এ সংকট কতটা গুরুতর তারা মনে করছেন, এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাকে। তিনি বলেন, এটি অনেক সিরিয়াস ব্যাপার। প্রায় কয়েক মাস যাবৎ এনজিওগুলো বলেছে। কিন্তু সরকার কোন বাহ্যিক ভূমিকা নেয়নি। কিন্তু এখন এটি গণমাধ্যমে চলে এসেছে ও পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ। আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাছে থাকা কেস-স্টাডি অনুযায়ী পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রে রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আছে উপকূলে। মৃত্যুর হারও ভয়াবহ। কিছু নৌকায় অর্ধেকের মতো মারা গেছে। কয়েকটিতে ৪০-৫০ জন মারা গেছে। আমরা এখনও অনুমান করতে পারছি না ঠিক কতজন মারা গেছে। কিন্তু সংখ্যাটা অনেক বেশি।

No comments

Powered by Blogger.