তীরের প্রতীক্ষায় আরও ছয় হাজার অভিবাসী

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের কুয়ালা লংসার আশ্রয়কেন্দ্রে
দুই রোহিঙ্গা শিশু দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাহিল
হাড্ডিসার শরীরে খাবার গ্রহণের শক্তিটুকুও নেই-এএফপি
এখনও প্রায় ছয় হাজারের বেশি অভিবাসী অথৈ সাগরে ভাসছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কাছাকাছি উপকূল এবং সাগরে তাদের বহনকারী নৌযানগুলোতে এখন চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। খাবার-পানির অভাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন সবাই। অনেকেই ভয়াবহ অসুস্থ-মুমূর্ষু। অসহায় এ মানুষগুলোর চোখে এখন শুধু তীরে ফেরার আকুতি। তবু সংশ্লিষ্ট দেশগুলো উদ্ধার অভিযানে ততটা সক্রিয় হচ্ছে না।
সাগরে ভেসে থাকা অনেককে হেলিকপ্টার থেকে খাবার দিলেও তাদের তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না ওই অঞ্চলের দেশগুলো। শনিবারও অভিবাসী ভর্তি একটি নৌযান তীর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে মালয়েশিয়া। ইউএনএইচসিআরের একজন কর্মকর্তা জেফরি স্যাভেজ বলেছেন, সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতার কোনো লক্ষণই তিনি এখনও দেখতে পাননি। বন্দর উন্মুক্ত রাখার জন্য আবারও তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে ইন্দোনেশিয়া উপকূল থেকে আরও ২শ’ অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে দেশটির নৌবাহিনী। এ নিয়ে ৮ মে থেকে প্রায় তিন হাজার অভিবাসী উদ্ধার হল। এদের মধ্যে ৬০৩ জন বাংলাদেশীর পরিচয় নিশ্চিত করা গেছে। এএফপি, বিবিসি বাংলা, রয়টার্সসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং মালয়েশিয়া থেকে যুগান্তর প্রতিনিধির পাঠানো খবর।
মালয়েশিয়ার নৌযানগুলো শনিবারও একটি অভিবাসী ভর্তি নৌকা তাদের জলসীমা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। মালয়েশিয়ান একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই নৌকাটি প্রথম থাইল্যান্ড যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে থাই নৌবাহিনী দু’বার তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। তবে তারা নৌকার ইঞ্জিনটি মেরামত করে দেয় এবং আরোহীদের খাদ্য, পানি, জ্বালানি তেল ইত্যাদি দিয়ে আবার সাগরে ফিরিয়ে দেয়।
ইন্দোনেশিয়ার আচেহ উপকূলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে আসা আরও ২শ’ অভিবাসী উদ্ধার হয়েছে। সকালে অভিবাসীদের উদ্ধার করে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। ধারণা করা হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ার জলসীমা থেকে নৌকা ফিরিয়ে দেয়ার ভয়ে তারা পানিতে লাফ দিয়ে পড়ে। এর আগে শুক্রবার একটি ডুবন্ত নৌকা থেকে প্রায় ৮শ’ জনকে উদ্ধার করে ইন্দোনেশীয় জেলেরা। এ নিয়ে ৯ দিনে প্রায় তিন হাজার অভিভাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃতদের আপাতত রাখা হয়েছে আচেহ প্রদেশের ল্যাঙসা বন্দরের পণ্যাগারে। ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ প্রধান সুনারিয়া জানান, অভিবাসীদের নৌকাটি দু’দিন আগে ফিরিয়ে দেয় মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের গহীন জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর মানব পাচার চক্রের খবরগুলো দ্রুত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নতুন করে শুরু হয় তোলপাড়। থাই সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করায় এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সরকার তাদের সমুদ্রসীমায় নজরদারি বাড়িয়ে দেয়ায় মাঝ সমুদ্রে আটকা পড়ে যায় পাচারকারীদের নৌকায় থাকা হাজার হাজার যাত্রী। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুযায়ী ছয় হাজারেরও বেশি অসুস্থ ও ক্ষুধার্ত অবৈধ অভিবাসী এখনও সমুদ্রে ভাসছে। হেলিকপ্টার থেকে খাবার দিলেও তা খুব সামান্য। খাবার পানির অভাবে অভিবাসীদের অনেকেই এখন মৃত্যুমুখে। তাদের শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হাড্ডিসার ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঠিকমতো বসতেও পারেন না তারা। তাদের চোখে এখন শুধুই তীরে ফেরার আকুতি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে কক্সবাজার ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মানব পাচার সিন্ডিকেটের সদস্যরা অল্প টাকায় এসব মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে ‘স্বপ্নের’ মালয়েশিয়ায় পাঠানো শুরু করে। মালয়েশিয়ায় কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশী শাহাদাত হোসেন লিটন জানান, মানব পাচারের বড় একটি সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর, সোবাং ও পেনাংয়ে অবস্থান করছে। এই চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশে থাকা সিন্ডিকেটের সদস্যদের সার্বিক তথ্য দিচ্ছে টেলিফোনে। যাদেরকে টেকনাফ দিয়ে ট্রলারে উঠাতে পারছে তাদের বলে দিচ্ছে সঙ্গে চিড়া-মুড়ি নিলেই হবে। কোনো টাকা লাগবে না।
বন্দর উম্মুক্ত রাখার তাগিদ : ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রতি আবারও বন্দর উম্মুক্ত রাখার তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অভিবাসী বহনকারী নৌকাগুলো সাগরে ফেরত না পাঠিয়ে তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেফ রাথেক এ তথ্য দেন। তিনি বলেন, অভিবাসীবাহী নৌকাগুলো যাতে সাগরে না পাঠানো হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। এদিকে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা বলেন, আশ্রয় প্রার্থীদের গ্রহণ না করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অভিবাসন সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানায় সংস্থাটি।
সব বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে আনা হবে : ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেন, পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে আটকে পড়া সব বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে আনা হবে। তবে রোহিঙ্গাদের কোনো দায়িত্ব নেবে না বাংলাদেশ। তিনি জানান, মিয়ানমারে একজন বিশেষ দূত পাঠিয়ে থাইল্যান্ড বাংলাদেশের সঙ্গে এ অভিভাসন ইস্যু নিয়ে আলোচনার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার এ ইস্যুতে আলোচনা করতে অস্বীকার করেছে। পররাষ্ট্র সচিব ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মিয়ানমার যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান না করবে ততদিন এ সংকট কাটবে না। বাংলাদেশ কোনো দিন রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করবে না। প্রয়োজনে তাদের পুশব্যাক করা হবে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কনসুলার সাইদুল ইসলাম মুকুল জানান, সেখানে উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের মধ্যে ৬০৩ জন বাংলাদেশী বলে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ২৯ মে অনুষ্ঠেয় অভিবাসন সংকটবিষয়ক এক দিনের কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেবে বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়ায় মানব পাচার সহ্য করা হবে না -প্রধানমন্ত্রী নাজিব তুন রাজাক : মালয়েশিয়ায় মানব পাচার সহ্য করা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব তুন রাজাক। পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র উপকূলে বহু অভিবাসীর দুর্ভোগে গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন তিনি। এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এটি আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা। আমাদের অঞ্চলে অভিবাসীদের দুর্ভোগে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে আমাদের উপকূলে এসে পৌঁছেছে এবং আরও অনেকে পৌঁছার চেষ্টা করছে।’ তিনি জানান, সাগরে অভিবাসীর স্রোতে মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী মিয়ানমার সরকারের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া হবে।।
জিটুজির বাইরে লোক পাঠাবে না সরকার : শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কোতা কিনাবালুর সমুদ্র তীরের লি-ম্যারিডিয়ান হোটেলের বলরুমে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বলেন, দেশের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে রোল মডেল। পূর্ব মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে অনুষ্ঠেয় দু’দেশের সরকারি পর্যায়ের বৈঠকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে বলেও মন্ত্রী বলেন। অনুষ্ঠানে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নুরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ায় জিটুজির বাইরে গিয়ে লোক পাঠানোর কথা সরকার আপাতত ভাবছে না। তবে এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে কাজ চলছে।
হাইকমিশনার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় এখনও চল্লিশ লাখ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। বিশাল এই শ্রমবাজারে বাংলাদেশ কিভাবে সুবিধা নিতে পারে সে বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাবনা তুলে ধরব।’
টেকনাফে ৫ মালয়েশিয়াগামীকে কূলে পাঠাল পাচারকারীরা : থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ধরপাকড় ও পাহারা জোরদার হওয়ায় ৫ মালয়েশিয়াগামীকে কূলে ফেরত পাঠিয়েছে মানব পাচারকারীরা। সকালে টেকনাফের সাবরাং-নয়াপাড়া ওবিএম ঘাট এলাকা থেকে ফিরে আসা এসব যাত্রীকে আটক করে থানায় সোপর্দ করেছে বিজিবি। আটককৃতরা হচ্ছেন- সুনামগঞ্জের ধিরাই থানার খেজাউড়া গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে মো. মনসুর আলী, দোহারা থানার পূর্ব পলিচর এলাকার মো. সাবাজ আলীর ছেলে মো. আঃ কুদ্দুস, সদর থানার বাজারগাঁও এলাকার মো. আকলাকুল ইসলামের ছেলে মো. মাজহারুল ইসলাম, ঝিনাইদহ জেলার শৈলাকূপা থানার বারইহুদা এলাকার মো. নজরুল শাহের ছেলে মো. রতন শাহ ও মো. আখিরুল খাঁনের (লালু) ছেলে মো. শাহীন খান।
এদিকে টেকনাফ কোস্টগার্ডের স্টেশন কমাণ্ডার মোহাম্মদ শাহীদ হোসেন চৌধুরী বলেন, সমুদ্রে তীরবর্তী একেকটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাহারা দেয়ার জন্য যে পরিমাণ নৌযান দরকার, তার অভাব আছে। তাদের কিছু হাইস্পিড বোট থাকলেও গভীর সমুদ্রে পাহারা দেয়ার মতো নৌযান এখনও নেই বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া তাদের পক্ষে সাগরে ভাসমান সব নৌযান তল্লাশি করাও সম্ভব হয় না।

No comments

Powered by Blogger.