নয়া কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে বিএনপি by কাফি কামাল

আন্দোলনের কৌশল হিসেবেই চলমান কর্মসূচি থেকে কিছুটা সরে এসেছে বিএনপি। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আপাতত সিটি নির্বাচনেই মনোযোগী তারা। প্রার্থী চূড়ান্তকরণ, নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন, জনসংযোগে নেতাকর্মীদের অংশ নিশ্চিতকরণ এবং প্রচার-প্রচারণার কৌশল প্রণয়নে জোরেশোরেই কাজ শুরু করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। জনসংযোগের মাঠে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ, সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন, নেতাকর্মীদের মামলা থেকে জামিনসহ গুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ততা বাড়ছে বিরোধী জোটে। তিন সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়েই নতুন গতিপ্রকৃতিতে সামনের দিকে এগোতে চাইছে তারা। এখন থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজেই বিষয়গুলো মনিটরিং করবেন। বিএনপি ও জোটের একাধিক নেতা এমন তথ্য জানিয়েছেন। নেতারা জানান, সিটি নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বাছাই সম্পন্ন হলেও এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসতে পারেননি বিরোধী জোট সমর্থিত প্রার্থীরা। মামলার কারণে আত্মগোপনে থেকেই তারা সারছেন প্রয়োজনীয় কাজ। মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে গাঢাকা দিয়ে আছেন কর্মী-সমর্থকরাও। এখন পর্যন্ত রাজধানীর কোথাও ২০ দলের সমর্থন প্রত্যাশীদের ব্যানার-পোস্টার উঠেনি। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে নির্বাচনের মাঠে লড়াই জমিয়ে তুলতে পারবেন না তারা। তাই নির্বাচনী মাঠে প্রকাশ্যে জোরালো তৎপরতা শুরু করার জন্য প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা উচ্চ আদালত থেকে জামিনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী ৯ই এপ্রিলের পর থেকে তারা প্রকাশ্যে আসতে চান। নেতারা জানান, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বৃহত্তর অর্থে আন্দোলনের মাঠে নামতে পারেননি ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরবাসী। কিন্তু নির্বাচনের মাঠে মহানগরবাসীকে সর্বাত্মকভাবে মাঠে নামাতে চায় বিএনপি। এ জন্য তৃণমূল নেতাকর্মীরা মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় জাতীয়তাবাদী ঘরানার বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত প্ল্যাটফরমের ব্যানারে সে প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া, প্রতি ওয়ার্ডে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠনসহ নানা কর্মপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। আর নির্বাচনকেন্দ্রিক উদ্যোগগুলো সফল করতে দুই মহানগরকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া, আগামী ৯ই এপ্রিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বিএনপি। এরপর নির্বাচনী প্রচারণার ব্যাপারে প্রকাশ্যে আসবেন খালেদা জিয়া। এরই মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটি ও জোটের বৈঠক ডাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে আলোচনা করেই নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে। নেতারা জানান, ফের সংবাদ সম্মেলন ডাকতে পারেন খালেদা জিয়া। সেখানে অবরোধ কর্মসূচি তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তেমনটি হলে শিগগিরই চট্টগ্রাম সফর করে মহানগরে এক বা একাধিক নির্বাচনী সমাবেশ করতে পারেন। আবার ঢাকায়ও কয়েকটি সমাবেশ করবেন। নেতারা জানান, সিটি নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর সামনে নির্বাচনী বিধির প্রতিবন্ধকতা থাকলে  পছন্দের প্রার্থীদের জন্য ভোট চাইতে খালেদা জিয়ার আইনি বাধা নেই। কারণ, তিনি এমপি-মন্ত্রী বা জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নন। নেতারা মনে করেন, দলের চেয়ারপারসন মাঠে নামলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে সাড়া পড়বে। খালেদা জিয়া মাঠে থাকলে হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। এতে দ্রুতই চাঙ্গা হয়ে উঠবে নেতাকর্মীরা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তিন সিটিতে বিজয় নিশ্চিত হলে নেতাকর্মীরা সারা দেশের মানুষ অনুধাবন করতে পারবে বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। কাজেই সিটি নির্বাচনে বিজয় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে আন্দোলনে। নেতারা জানান, নির্বাচনী পরিস্থিতি, সরকারের মনোভাব ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করছেন বিরোধী জোট নেতা খালেদা জিয়া। নেতারা জানান, ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’ ব্যানারে ঢাকা সিটি নির্বাচনে প্রচারণা চালাবে বিএনপি। স্লোগান হবে ‘পরিচ্ছন্ন ঢাকা চাই, নিরাপদ ঢাকা চাই’। পেশাজীবীদের সমন্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক ও সাংবাদিক শওকত মাহমুদকে সদস্য সচিব করে ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’-এর কমিটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর ১০০১ সদস্যবিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। এছাড়া দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে। উভয় দিক থেকে সুন্দর ও বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু করা হবে জনসংযোগ। ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি থানায় নির্বাচন পরিচালনার জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা অনুযায়ী ৪০টির মতো ওয়ার্ড কমিটি জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। সে কমিটির পরামর্শ অনুযায়ীই নির্বাচন কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট চূড়ান্ত করা হবে। ইতিমধ্যে সিটি নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের ইশতেহার প্রণয়নের কাজ শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা। নেতারা জানান, শেষ পর্যন্ত ঢাকায় দলের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করতে না পারলে বয়কটের বিষয়টিও বিবেচনার মধ্যে রাখা হচ্ছে। এদিকে ঢাকার দক্ষিণে মেয়র পদে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের সমর্থন চূড়ান্ত হলেও উত্তর নিয়ে শেষ মুহূর্তের বিশ্লেষণ করছে বিএনপি। সেখানে বিএনপি জোটের মূল প্রার্থী আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়নপত্র সর্বোচ্চ আদালতেও বাতিল হওয়ায় বিকল্প প্রার্থীকেই সমর্থন দিতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সার্বিক বিবেচনায় জাতীয়তাবাদী ঘরানার সমমনা রাজনৈতিক দল বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীর পাল্লাই ভারি। এর মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী ঘরানার ছোট ছোট দল ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সুদৃঢ় করতে চায় বিএনপি। এদিকে ৯২ দিন পর গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আদালতে হাজিরা দেন খালেদা জিয়া। আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর তিনি সোজা বাসায় ফিরে যান। সরকার ও বিরোধী দলের হঠাৎ নমনীয় আচরণে কৌতূহল তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। তৈরি হয়েছে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার একটি গুঞ্জন। রাজনৈতিক মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেউ কেউ বলছেন, পর্দার আড়াল থেকে কূটনীতিকদের ভূমিকা, সুশীল সমাজের ভূমিকায় ‘ডেডলক’ পরিস্থিতির একটি উত্তরণ ঘটেছে। সরকারের তরফে বিএনপির এ অবস্থানে খালেদা জিয়ার ‘শুভবুদ্ধি’ ও ‘বোধোদয়’ হিসেবে অভিহিত মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে জোটে। তবে নেতাদের বেশির ভাগই মনে করছেন, এটা আন্দোলনের কৌশল মাত্র। বরং ধাক্কা খেয়েছে সরকারের কৌশল। আবার কেউ কেউ বিষয়টিকে দেখছেন সরকার ও বিরোধী দলের ‘উইন উইন সিচ্যুয়েশন’ হিসেবে। রাজনৈতিক মহলের মতে, বিএনপি চেয়ারপারসন আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেছেন আর জামিন পেয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। অন্যদিকে সরকার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলে দিয়েছেন এবং খালেদা জিয়ার জামিন লাভে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। এ চারটি ঘটনায় রাজনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক বার্তা। এগুলো জনমনে যেমন স্বস্তি ফেরাবে তেমন দুইপক্ষকেই আগামী দিনের পথচলায় নতুন করে ভাবতে সহায়ক হবে। তবে বিএনপি নেতারা মনে করেন, আন্দোলন থেকে মোটেই সরে আসছে না বিএনপি। ঘরে ফেরা মানে থেমে যাওয়া নয়। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন ও নতুন মাত্রা দেয়ার কৌশল। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় কখনও ছাড় দিয়ে, কখনও বিরতি দিয়ে এগোতে হয়। এখানেও বিএনপির নমনীয় বা ছাড় দেয়ার বিষয়টি আসলে আন্দোলনের কৌশলের একটি অংশ। সিটি নির্বাচনে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় ছেড়েছেন। কারণ দীর্ঘ তিন মাস ধরে রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করেছেন খালেদা জিয়া। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও নেতাকর্মীদের যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা ছিল। ফলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে পারেননি তিনি। এখন পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন ঘটবে। আর এই সুযোগে খালেদা জিয়া একদিকে নির্বাচনী প্রচারে ভূমিকা রাখবেন, অন্যদিকে ফের তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে যাবেন। নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়া তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে যেতে পারলে আন্দোলনেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নেতারা জানান, খালেদা জিয়া ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্বাচনী সমাবেশ করতে পারলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। একদিকে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়া হবে, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সরকারের সমালোচনা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকার বিরোধী মনোভাব জোরালো করা যাবে। তিন সিটিতে বিজয় অর্জন হলে সরকারের ওপর নতুন করে জনমতের চাপে পড়বে। নেতারা জানান, আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সরকার সিটি নির্বাচন ঘোষণা করে। সরকার হয়তো ভেবেছিল, বিএনপি নির্বাচনে যুক্ত হবে না। এছাড়া আত্মগোপনে থাকা নেতারা অগোছালো সাংগঠনিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়ায় পাল্টে যায় পরিস্থিতি। নিজেদের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতেই সরকারকে কিছু ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে হচ্ছে। পাশাপাশি সে সুযোগ নিয়ে বিএনপিও কিছুটা নমনীয় হয়ে ফের প্রকাশ্যে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চাইছে। নেতারা জানান, খালেদা জিয়া কার্যালয়ে থাকলে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের রাজপথে নামানো কঠিন ছিল। নির্বাচনী প্রচারে সমন্বয় করার ব্যাপারে জটিলতা থাকতো অনেক বেশি। এখন খালেদা জিয়া অবাধে চলাফেরা ও নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারলে নেতাকর্মীরাও আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসার সাহস পাবেন। সাধারণ ভোটাররাও ইতিবাচক সাড়া দেবেন। তারা ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন। এদিকে খালেদা জিয়া জামিন পেয়ে বাসায় ফেরার পর রাজনীতির মাঠে কিছুটা সহনশীল পরিবেশ দৃশ্যমান হচ্ছে। শনিবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা খোলার পর তিনদিন নয়াপল্টন কার্যালয়ে নেতাকর্মীরা যেতে শুরু করেছেন। প্রতিদিনই বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনে যাচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.