টিলাগড় অশান্ত সর্বত্র আতঙ্ক by ওয়েছ খছরু

ঘুম হারাম টিলাগড়বাসীর। সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক নেমে আসে পুরো এলাকায়। দরজা-জানালা বন্ধ রেখে বন্দি জীবনযাপন করছেন এলাকাবাসী। ব্যবসায়ীরাও দোকানপাট বন্ধ করে চলে যাচ্ছেন। গোলাগুলি, ককটেলবাজি এলাকার সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। কোনভাবেই সন্ত্রস্ত টিলাগড় শান্ত হচ্ছে না। পুলিশও নির্বিকার। দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ নেই। চোখের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা ও দা নিয়ে মহড়া দেয়া হলেও তাদের কিছুই যেন করার নেই। দেখেও যেন না দেখার ভান করছে তারা। এ অবস্থায় এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে ভীতিময় পরিবেশ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টিলাগড়ে গুলির লড়াই শুরু হলে আর বন্ধ হতে চায় না। উত্তেজনা শুরু হলে চলে অনেক দিন। এ কারণে এমসি কলেজ, সরকারি কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী ওই এলাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীরাও অনিরাপদ হয়ে উঠেছেন। একসময় বেশ শান্ত ছিল টিলাগড়। সামাজিক বন্ধন ছিল সুদৃঢ়। গ্রাম্য সালিশ ও বিচারকদের দাপট ছিল এখানে। কিন্তু কালের পরিবর্তনে এ টিলাগড় ক্রমেই যেন পরিণত হচ্ছে সন্ত্রস্ত জনপদে। এক দশক আগে এ টিলাগড় পরিণত হয়েছিল অশান্ত জনপদে। তখন পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানের কারণে পুরোপুরি শান্ত অবস্থায় ফিরে এসেছিল। ডাকাত সরদার মজিদের প্রভাব এখন অনেকটা কমে এসেছে। হেরোইন কবিরেরও দাপট নেই আগের মতো। এ টিলাগড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল দেশ কাঁপানো জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমানকে। বর্তমান সময়ে টিলাগড় রাজনৈতিক ক্যাডারদের কারণে ফের সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আর এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় জনগণকে। সিলেটের টিলাগড়। এক নামেই সিলেটজুড়ে এ জায়গা চিনেন সবাই। কারণ, টিলাগড়েই পাশের দেশের প্রাচীনতম এমসি কলেজ ও সরকারি কলেজ। বর্তমানে টিলাগড়ের পার্শ্ববর্তী গড়ে উঠেছে তিনটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মডেল স্কুল। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় ওই এলাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বসবাস বেশি। চাকরির সুবাদে শিক্ষকরা ও শিক্ষার সুবাদে শিক্ষার্থীদের বাস ওই এলাকায়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ওই এলাকার পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে। তুচ্ছ ঘটনায় টিলাগড়ে হচ্ছে গোলাগুলি, ককটেলবাজি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা। দুই দিন ধরে ছাত্রলীগের বিবদমান ওই দুই গ্রুপ মুখোমুখি থাকায় টিলাগড়ে চলছে গুলির লড়াই। এ ঘটনার শুরু অনেক আগে থেকেই। এমসি কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দখল ও টেন্ডারবাজি নিয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিরন মাহমুদ নিপু ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। আগে দুই গ্রুপের নেতারা একসঙ্গে থাকলেও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বনিবনা না হওয়ার কারণে তারা মুখোমুখি রয়েছে। এবারের ঘটনার শুরু মঙ্গলবার পহেলা নববর্ষের দিন। এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ক্যাম্পাসে নববর্ষের আয়োজন করা হয়। প্রতিবারই একইভাবে চলে আয়োজন। এ আয়োজনে কলেজের সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা শরিক হন। আর ঐতিহ্যগতভাবে এমসি কলেজ নববর্ষ পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এমসি কলেজে জমকালোভাবেই নববর্ষের আয়োজন করা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ কারণে নববর্ষের দিন সকাল থেকে সিলেটের মানুষের ঢল নামে এমসির ক্যাম্পাসে। কিন্তু বিকালে নববর্ষের অনুষ্ঠান পরিণত হয় বিষাদে। নববর্ষের অনুষ্ঠান চলার সময় বিকাল চারটায় ছাত্রলীগের নীপু ও জাহাঙ্গীর গ্রুপের কর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। এ সময় এমসির ক্যাম্পাসের নববর্ষের প্যান্ডেলসহ যাবতীয় স্থাপনাতে ভাঙচুর চালায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। দুই পক্ষই ককটেলবাজির পর জড়িয়ে পড়ে বন্দুকযুদ্ধে। এতে তিন ছাত্রলীগ কর্মী গুরুতর আহত হয়। তাদের ওই দিন বিকালেই সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এমসির ক্যাম্পাসে দফায় দফায় সংঘর্ষের পর এমসির ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে পুলিশ। তারা ছাত্রলীগের বিবদমান দুটি গ্রুপকে দুই দিকে সরিয়ে আনে। এরপর ছাত্রলীগের নীপু গ্রুপের কর্মী প্রকাশ্য হাতে রামদা, দা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গোপালটিলা এলাকায় অবস্থান নেয়। আর জাহাঙ্গীর আলমের গ্রুপের কর্মীরা অবস্থান নেয় টিলাগড় এলাকায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে টিলাগড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সংঘর্ষের আশঙ্কায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে সন্ধ্যা রাতেই বাসায় ফিরে যান। আর স্থানীয় লোকজনও আটকা পড়েন বাসাবাড়ির ভেতরেই। আতঙ্কের মধ্যে রাত কাটানোর পর সকালের দিকে কিছুটা শান্ত ছিল টিলাগড়ের পরিবেশ। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই ফের অশান্ত হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার পর টিলাগড়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নীপু গ্রুপ ও জাহাঙ্গীর গ্রুপের কর্মীরা। এ সময় পুলিশের কয়েকটি ভ্যানও ওই এলাকায় দেখা যায়। রাত ৯টার পর পুরোপুরি অশান্ত হয়ে উঠে পরিবেশ। বিবদমান দুটি গ্রুপের মধ্যে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেলের শব্দে কেঁপে উঠে টিলাগড়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, টিলাগড় এলাকায় বিবদমান দুই গ্রুপের রণসাজ দেখেই অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দেন। তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করে এলাকা থেকে চলে যান। স্থানীয় লোকজনও বাসা ও বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন। রাতে প্রথম পর্যায়ে ধাওয়ার পর রাত সাড়ে ১১টায় বিবদমান গ্রুপের শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। সংঘর্ষকালে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে নীপু গ্রুপের কর্মীরা গোপালটিলা এলাকা দিয়ে চলে যায়। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। পালিয়ে যাওয়ার পর জাহাঙ্গীর গ্রুপের কর্মীরা হানা দেয় গোপাল টিলায়। এ টিলাগায় অধিকাংশ সংখ্যালঘু পরিবারের বসবাস। জাহাঙ্গীর গ্রুপের কর্মী গোপালটিলার গলিতে ঢুকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় তারা হাতে থাকা রামদা ও দা দিয়ে ঘর-বাড়ির দরোজা-জানালা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন আতঙ্কে চিৎকার শুরু করেন। পরে পুলিশ গিয়ে বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। রাতেই শাহপরান থানার ওসি সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, পুলিশের সংখ্যা কম থাকায় প্রথমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এনে ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়। তিনি দাবি করেন, রাত থেকেই টিলাগড়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এদিকে, রাতের হামলার ঘটনার পর টিলাগড়ের পার্শ্ববর্তী গোপালটিলাসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দা আতঙ্কে রয়েছে। রাতে যে মোটরসাইকেলে আগুন দেয়া হয়েছিল সেটির ভস্মীভূত অংশ গতকাল পর্যন্ত রাস্তায় পড়ে থাকলেও সেটি কেউ সরিয়ে নেয়নি। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, টিলাগড়ের বিবদমান দুটি গ্রুপের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশী অস্ত্র রয়েছে। তুচ্ছ ঘটনায় সেগুলো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পুলিশ অস্ত্র উদ্ধার না করায় এমসি কলেজের ক্যাম্পাসের পাশাপাশি টিলাগড়েও নেমে এসেছে আতঙ্কময় পরিবেশ। আর পুলিশ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ না করায় ক্রমেই টিলাগড় পরিণত হচ্ছে সন্ত্রস্ত জনপদে।

No comments

Powered by Blogger.