আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তাত্ত্বিক গুরু মুফতি ফরিদী by উবায়দুল্লাহ বাদল

মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের পূর্ব পাশে মসজিদুল মোমেন জামে মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল হাকিম ফরিদী উগ্র জিহাদি মতবাদ প্রচার করছেন। পাশাপাশি নাস্তিক ও মুরতাদদের কতল (জবাই) করতে সাধারণ জনগণসহ জঙ্গি গোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করছেন। তিনি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) প্রতিষ্ঠাতা মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানীর ঘনিষ্ঠ সহচর। রাহমানীর অবর্তমানে তার অনুসারীরা মুফতি ফরিদীকেই তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে বিশ্বাস করেন। এ মুহূর্তে রাহমানী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে এ তথ্য।
ইমাম আবদুল হাকিম ফরিদীর অপতৎপরতা বন্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ৩ দফা সুপারিশ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- ১. ফরিদীকে উগ্র জঙ্গিবাদী মতবাদ প্রচারের অভিযোগে অতি দ্রুত গ্রেফতার করে তাকে আইনের আওতায় আনা ২. তার কাছ থেকে অভিজিৎ রায়সহ অন্যান্য ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং ৩. মিরপুরের মসজিদুল মোমেন জামে মসজিদ চত্বরে উগ্রবাদী লেখকদের বই বিক্রি বন্ধ করা।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, মুফতি আবদুল হাকিম ফরিদী প্রায়ই জুমার নামাজের খুতবায় বাংলাদেশের জিহাদি তরুণ মুজাহিদদের অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামবিদ্বেষী তথাকথিত নাস্তিক-মুরতাদ মুক্ত করার আহ্বান জানান। উক্ত আহ্বানের প্রতিফলন স্বরূপ ধারাবাহিকভাবে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ব্লগার আশরাফুল আলমকে সাভারে, ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর একেএম সাইফুল ইসলামকে ক্যাম্পাসের কাছে এবং সর্বশেষ ২৬ ফেব্র“য়ারি আমেরিকান প্রবাসী লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের কাছে জিহাদি জঙ্গি গোষ্ঠী দেশীয় অস্ত্র দ্বারা নির্মমভাবে হত্যা করে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আবদুল হাকিম ফরিদীর নানা অপতৎপরতার বিশদ বর্ণনা দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু মন্তব্য করা হয়। এতে বলা হয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বর্তমান শায়খ আবদুল হাকিম তার আদর্শিক গুরু জসীমউদ্দিন রাহমানীর ন্যায় জুমার খুতবা ও বিভিন্ন ধর্মীয় জলসায় জিহাদি বক্তব্য দেন। এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণসহ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি, হুজি-বি, হিজবুত তাহরীরসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্য এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে উগ্র জিহাদি মতবাদ প্রচার করা হচ্ছে। যা দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। উল্লিখিত হত্যাকাণ্ডে প্রতীয়মান হয় যে, আবদুল হাকিম কর্তৃক ইসলামবিদ্বেষী তথা নাস্তিক-মুরতাদদের সরাসরি গলা কেটে কতল করার উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরা তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অপপ্রয়াস চালাচ্ছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবেদনে আরু বলা হয়- জসীমউদ্দিন রাহমানীর অনুপস্থিতিতে আবদুল হাকিম ফরিদীকে এবিটির সদস্যরা তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে মানে। তার উদ্দীপনামূলক জিহাদি বক্তব্য শুনতে এবিটি ছাড়াও আল কায়েদা ইন এরাবিয়ান পেনিনসুলা (একিউএপি), ইসলামিক স্টেট (আইএস), জেএমবি, হুজি-বি, হিজবুত তাহরীরসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সন্দেহভাজন সদস্যরা প্রায়ই জুমার নামাজ আদায় করতে মসজিদুল মোমেন জামে মসজিদে যায়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- তিনি জিহাদকে ইসলাম কায়েমের পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করে আল-কোরআনের উদ্বৃতি দিয়ে জিহাদকে ইসলামের একটি অধ্যায় বলে প্রচার করেন। জিহাদকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে গত বছরের ৮ আগস্ট জুমার বয়ানে তিনি বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত তার বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, এমনকি আত্মীয়-স্বজনদের জিহাদ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া। প্রত্যেক মুসলমানদের উচিত তাদের সন্তানকে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদের সঠিক সময় সম্পর্কে অবগত করানো। জিহাদের তিনটি পদ্ধতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরাসরি অংশগ্রহণ, মুজাহিদিনদের অর্থের জোগান ও মুজাহিদিনদের জন্য দোয়া করা।
এছাড়া গত বছরের ২৪ অক্টোবর জুমার নামাজের বয়ানে বাংলার মুজাহিদদের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ন্যায় নাস্তিক-মুরতাদদের সরাসরি গলা কেটে কতল করার দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান মুফতি আবদুল হাকিম ফরিদী। গত বছরের হজের সময় সৌদি আরবের জনৈক আল্লামা হোসেন তাকে বাংলাদেশে সরাসরি জিহাদের ডাক দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বলেও তিনি উপস্থিত মুসুল্লিদের মধ্যে প্রচার করেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, জিহাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে উল্লেখ করে ২ জানুয়ারি জুমার বয়ানে আবদুল হাকিম বলেন, আমি শুনেছি কিছু বাংলাদেশী যুবক ভাই কাফের-নাসারদের বিপক্ষে জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, ইয়ামেন ও কাশ্মীরে গেছেন। সেখানে তারা বন-জঙ্গল ও পাহাড়ি গুহায় লুকিয়ে থেকে সারাবিশ্বে ইসলামী খিলাফত কায়েমের জন্য বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করছেন। তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য কিন্তু তাদের মানসিক শক্তি প্রশংসনীয়। সবার উচিত তাদের কাছ থেকে উৎস গ্রহণ করা।
মসজিদুল মোমেন জামে মসজিদ চত্বরে ইমাম আবদুল হাকিম ফরিদীর জিহাদি বই ও সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচার এবং জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ অন্যান্য উগ্রবাদী লেখকের বই সুলভে পাওয়া যায়। এ কারণে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে উক্ত মসজিদটি জিহাদ প্রেমী ও উগ্রবাদীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করা হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
৬ সপ্তাহ ধরে মসজিদে অনুপস্থিত ফরিদী ঃ ১৭ এপ্রিল জুমার নামাজের সময় সরেজমিন মসজিদুল মোমেনে গিয়ে দেখা গেছে মুফতি ফরিদীর অনুপস্থিতিতে পেশ ইমাম জুমার নামাজ পড়াচ্ছেন। নামাজ শেষে ফরিদীর বিষয়ে জানতে চাইলে মসজিদের মোয়াজ্জিন শরিফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ৬ জুমা ধরে অসুস্থতার কারণে খতিব (ফরিদী) মসজিদে আসছেন না। প্রায় সময়ই মোবাইল ফোন বন্ধ থাকে। প্রয়োজন হলে অন্য মোবাইল ফোন থেকে তিনি আমাদের কল করেন। উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি যা বলেন তা হাদিস-কোরআনের উদ্বৃতি দিয়েই বলেন। তার বাইরে কোনো কথা বলেন বলে আমার জানা নেই। তবে কেউ ইনডাইরেক্ট বললেও তিনি ডাইরেক্ট কথা বলেন। তার সরাসরি কথা বলার কারণে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মুসুল্লি মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। এ সময় একাধিকবার ফরিদীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
মসজিদের সামনে বইয়ের দোকান থাকলেও শুক্রবার সেখানে জসীমউদ্দিন রাহমানী বা মুফতি ফরিদীর কোনো বই পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দোকানদার জানান, উগ্রবাদী মতাদর্শের কোনো বই তিনি বিক্রি করেন না। এ সময় একাধিক মুসুল্লি যুগান্তরকে বলেন, মুফতি ফরিদী গত প্রায় ১০ বছর ধরে এ মসজিদে জুমার নামাজ পড়ান। বিএনপি জোট সরকারের সময়ও তিনি সরকারের কঠোর সমালোচনা করে খুতবা দিতেন। ওই সময়ও তাকে পুলিশি হয়রানি করা হয়েছিল। শুনেছি বর্তমান সরকারও তাকে নানাভাবে হয়রানি করছে।

No comments

Powered by Blogger.