জন্মদিনের কেক খাওয়াতে এসে কাবেরিকে খুন

জন্মদিনের কেক ও জুস নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক কর্মকর্তার বাসায় ঢুকে হামলা চালিয়েছে এক দুর্বৃত্ত। তার ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছেন ওই কর্মকর্তার স্ত্রী। দুই কন্যাসহ ওই কর্মকর্তা নিজেও আহত হয়েছেন। সোমবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিআরটিএ’র উপ-পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের বাসায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত কৃষ্ণা কাবেরী মণ্ডল মোহাম্মদপুরের মিশন ইন্টারন্যাশনাল কলেজের প্রভাষক। এ ঘটনায় জহিরুল ইসলাম নামে এক যুবককে খুঁজছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, জহিরুল একাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে। তবে কি কারণে এবং কেন শীতাংশু শেখরের বাসায় জহিরুল হামলা চালায় তা জানা যায়নি। পুলিশ ও নিহতের স্বজনেরা জানান, জন্মদিনের কেক ও জুস নিয়ে বাসায় ঢুকেছিলো ওই যুবক। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই সে এসেছিল বলেই মনে করেছিলেন শীতাংশু ও তার স্ত্রী, সন্তানরা। এ ঘটনায় আহতদের বরাত দিয়ে শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের বোন করুণাময়ী বিশ্বাস জানান, বাসায় ঢোকার কিছু সময়ের মধ্যেই কেক খাওয়ার জন্য সবাইকে ড্রয়িংরুমে ডাকে ওই যুবক। কিন্তু তারা তখনও ড্রয়িং রুমে যাননি। এক পর্যায়ে শীতাংশুকে কেক ও জুস খাওয়ায় সে। জুস পান করার পরপরই শীতাংশু প্রায় অচেতন হয়ে যান। বিষয়টি তারা টের পান কিভাবে জানতে চাইলে করুণাময়ী আহতদের বরাত দিয়ে জানান, এসময় সোফা থেকে মেঝেতে পড়ে যান শীতাংশু। শব্দ শুনে তার আট বছর বয়সী কন্যা অদ্রিতা বিশ্বাস ছুটে গেলে তাকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে ওই দুর্বৃত্ত। এর মধ্যেই কৃষ্ণা গিয়ে দেখতে পান একটা কাগজে স্বাক্ষর নিতে শীতাংশুকে জোর করছে ওই যুবক। হাতুড়ি দিয়ে শীতাংশুকে আঘাত করছে সে। কৃষ্ণা বাধা দিতে গেলে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে ওই দুর্বৃত্ত। কৃষ্ণা তখন তাকে হাত জোর করে বলেন, যা বলবেন তাই করব তবু আমাদের মারবেন না প্লিজ। এক পর্যায়ে ওই কাগজে শীতাংশুর স্বাক্ষর আদায় করে সে। শীতাংশুর বোন করুণাময়ী আরও জানান, বিষয়টি পর্দার আড়াল থেকে দেখে ভেতরের একটি কক্ষের দরজা বন্ধ করে সেখানে আশ্রয় নেয় শীতাংশুর বড় মেয়ে শ্রাবণী বিশ্বাস শ্রুতি। ওই সময়ে সে খুলনার ডুমুরিয়ায় তার নানাকে ফোনে বিষয়টি জানায়। এক পর্যায়ে দরজা খুলে শ্রুতি দেখতে পায় ড্রয়িং রুমে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে ওই দুর্বৃত্ত। কৃষ্ণাকে টেনে নিয়ে আগুনের মধ্যে ফেলে দেয় সে। এতে ঝলসে যায় কৃষ্ণার শরীর। একটি ফুলদানি হাতে নিয়ে ওই দুর্বৃত্তকে আঘাত করতে গেলে শ্রুতির ডান ও বাম হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায় হামলাকারী। এসময় প্রতিবেশীদের দরজায় নক করে বিষয়টি তাদের জানায় শ্রুতি ও অদ্রিতা। পরে প্রতিবেশীরা কৃষ্ণাকে উদ্ধার করে প্রথমে নিকটস্থ সিটি হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত প্রায় ২টায় কৃষ্ণার মৃত্যু হয় বলে জানান মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাশেদুল ইসলাম। এ ঘটনায় আহত শীতাংশু শেখর বিশ্বাস ও তার দুই কন্যাকে মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
করুণাময়ী জানান, রাত প্রায় ৯টার দিকে ইন্টারকম থেকে কল করলে কথা বলেন শীতাংশু। এসময় তাকে জানানো হয় আপনার একজন অতিথি এসেছেন। নাম বলার পর তাকে ওপরে পাঠাতে বলেন শীতাংশু। দ্বিতীয় তলায় তার ফ্ল্যাটে ঢোকার কিছু সময়ের মধ্যেই হামলা করে ওই দুর্বৃত্ত। এক ঘণ্টার মধ্যে পুরো ঘটনাটি ঘটে বলে জানান তিনি। শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের বোন করুণাময়ী জানান, শীতাংশুর জন্মদিন গেছে কয়েক দিন আগে। ওই লোকটি বাসায় ঢুকেই তাকে বলেছে- জন্মদিনে আসতে পারিনি। দেরিতে হলেও আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে এলাম।
গতকাল বিকালে শীতাংশুর ইকবাল রোডের বাড়িতে গেলে কথা হয় প্রহরী আবদুর রহিমের সঙ্গে। তিনি জানান, ঘটনার সময় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করছিলেন ফারুক। ফারুকের বরাত দিয়ে তিনি জানান, রাত ৯টার পর জহিরুল ইসলাম পরিচয় দিয়ে এক যুবক শীতাংশুর বাসায় যেতে চান। পরে ইন্টারকম থেকে কল করে অনুমতি নিয়ে তাকে যেতে দেন ফারুক। রাত ১০টার পর জহিরুল বের হয়ে যাওয়ার পরে তিনি জানতে পারেন শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে।
শীতাংশুর প্রতিবেশী প্রকৌশলী সাবের আহমেদ জানান, শ্রুতি ও অদ্রিতার চিৎকার শুনে দরজা খুলেন তিনি। রক্তাক্ত শ্রুতি ও অদ্রিতার কথা শুনে শীতাংশুর ফ্ল্যাটে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন সাবের ও তার পরিবারের সদস্যরা। এসময় প্রতিবেশী আরও অনেকে ছুটে যান। সাবের জানান, এসময় পর্দার পাশে দগ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় কৃষ্ণাকে দেখতে পান তিনি। সাবের বলেন, ওই অবস্থায়  জাকির নামে একজনকে দায়ী করেন শীতাংশু। তিনি তাদের বলেছেন জাকির এই ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে জহিরুল নামে এক যুবক এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হাজী আহমেদ সিকিউরিটিজ নামের একটি ব্রোকার হাউজের ম্যানেজার জহিরুল। রাজধানীর গুলশানের ১৫ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাটে থাকে সে। কিন্তু ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছে সে। স্বজনেরা জানান, স্ত্রী কৃষ্ণা কাবেরী মণ্ডল ও দুই কন্যা শ্রুতি এবং অদ্রিতাকে নিয়ে ইকবাল রোডের ৩/১২ নম্বর পাঁচ তলা বাড়ির দু’তলার ফ্ল্যাটে থাকেন বিআরটিএ’র কর্মকর্তা শীতাংশু শেখর বিশ্বাস। তার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি থানার ডহর গ্রামে। তার পিতার নাম যতীন্দ্র নাথ বিশ্বাস। এ ঘটনায় নিহত কৃষ্ণা কাবেরী মণ্ডলের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.