মিন্টু-পিন্টুর মনোনয়ন বাতিল, আপিলের প্রস্তুতি

ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তরে মেয়র পদপ্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও দক্ষিণে বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের প্রথম দিনে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। এদিন ঢাকা উত্তরে আরও একজন এবং দক্ষিণে পিন্টু ছাড়া আরও দুজনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। বিএনপির দুই নেতার প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়ে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবীরা। তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে আপিলের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলম জানান, আবদুল আউয়াল মিন্টুর সমর্থক আবদুর রাজ্জাক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা না হওয়ায় মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। আরেক মেয়র প্রার্থী নাঈম হাসান ঋণখেলাপি হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। যেসব প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে তারা তিন দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারোয়ার মোর্শেদ জানান, নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুসহ তিনজনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় পিন্টুর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে মনোনয়নপত্র বাতিলের পর গতকাল দুপুর থেকেই আবদুল আউয়াল মিন্টুর আইনজীবীরা তৎপর ছিলেন। বিকাল ৪টায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ ৯ আইনজীবী। বিকাল সাড়ে ৪টায় ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি আইনজীবী দল মিন্টুর মনোনয়ন বাতিল পুনর্বিবেচনার জন্য রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কার্যালয়ের প্রধান ফটকে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। এ সময় কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার প্রবেশপথে বাধা দিয়ে আইনজীবীদের বলেন, ‘এখন ওপরে যাওয়ার নির্দেশ নেই।’ আইনজীবীদের পক্ষ থেকে প্রায় আধঘণ্টা অনুরোধের পর কর্তব্যরত পুলিশ ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাসুদ আহমেদ তালুকদারকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলমের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেন। পরে মিন্টুর দুই আইনজীবী দেখা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলমের সঙ্গে। এ সময় দুই আইনজীবী আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে একটি লিখিত আবেদনপত্র জমা দেন। সেই সঙ্গে প্রায় ১০ মিনিট আলাপ হয় উভয় পক্ষের। এ সময় আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতা বৈধ দাবি করে দুই আইনজীবী আইনের ব্যাখ্যাও তুলে ধরেন রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে। জবাবে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা আবেদন করেছেন। আমিও শুনেছি। আপনাদের আবেদনপত্র রাখলাম। কিন্তু প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এটি আমার আওতার বাইরে চলে গেছে। এখন পুরো বিষয়টি আপিল বিভাগের কাছে। প্রার্থীর বৈধতা নিয়ে আপনারা আপিল করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আমার আর কিছু করার নেই। এদিকে মো. শাহ আলমের এমন বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে ব্যারিস্টার খোকন বলেন, আইনজীবী হিসেবে আমরা আইনানুগভাবেই আজ লিখিত আবেদন নিয়ে দেখা করতে এসেছি। অথচ শুরুতেই বাধা পেয়েছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এটা খুবই দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, আইনকে ফলো না করে মাইনর গ্রাউন্ডে উনি (মো. শাহ আলম) আবদুল আউয়াল মিন্টু সাহেবের প্রার্থিতা বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি আজ (গতকাল) এখানে বসেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের যোগ্যতা বিবেচনার জন্য। মিন্টু সাহেব প্রার্থী হিসেবে কোনভাবেই অযোগ্য নন। তার যোগ্যতা নিয়ে যদি প্রশ্ন উঠতো অথবা প্রার্থিতা বাতিল হতো তাহলে আমাদের বলার কিছু ছিল না। মিন্টু সাহেবের আয়কর রিটার্নের কাগজ দিয়েছেন। তিনি ঋণখেলাপি নন। তিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি নন। তিনি ফেরারি আসামি নন। তার নাগরিকত্ব কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রেও কোন সমস্যা নেই। একজন প্রার্থী হিসেবে তার একটা অযোগ্যতাও খুঁজে পাননি রিটার্নিং অফিসার। অথচ ছোট্ট একটি মামুলি ভুলের অজুহাতে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হলো। এটা আইনবহির্ভূত। আমরা সেটিসফাইড না। অন্যদিকে এ সময় সাংবাদিকদের কাছে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার সিটি করপোরেশন আইনের রেফারেন্স তুলে ধরেন। যেখানে ১৪-এর (আ) ধারাতে লেখা আছে- ‘রিটার্নিং অফিসার গুরুতর নহে এইরূপ কোন ত্রুটির কারণে কোন মনোনয়নপত্র বাতিল করিবেন না এবং অনুরূপ ত্রুটি অবিলম্বে সংশোধন করিবার জন্য সুযোগ প্রদান করিতে পারিবেন।’ একই সঙ্গে (ই) ধারাতে লেখা আছে- ‘রিটার্নিং অফিসার ভোটার তালিকায় লিপিবদ্ধ কোন বিষয়ের শুদ্ধতা বা বৈধতা সম্পর্কে তদন্ত করিতে পারিবেন না।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে এ আইনের উল্লেখ করে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘তাহলে কি কারণে কোন আইনের ভিত্তিতে আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিল করা হলো? এর বিরুদ্ধে অবশ্যই আমরা আপিল করবো এবং আইন অনুযায়ী আপিল আমাদের পক্ষেই আসবে।
অন্যদিকে মনোনয়ন বৈধতা ঘোষণা করা হয় মিন্টুপুত্র তাবিথ আউয়াল ছাড়াও আনিসুল হক, শামছুল আলম চৌধুরী, চৌধুরী ইরাদ আহমদ সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল ক্বাফী, ববি হাজ্জাজ, এ ওয়াই এম কামরুল ইসলাম, বাহাউদ্দিন আহমেদ, নাদের চৌধুরী, কাজী মো. শহীদুল্লাহ, মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, সারাহ বেগম কবরী, মো. আনিসুজ্জামান খোকন, মো. জামান ভূঞা, শেখ শহিদুজ্জামান, মো. জোনায়েদ আবদুর রহিম সাকী, মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরী, শেখ মো. ফজলে বারী মাসউদ ও মোস্তফা আজাদী।
এদিকে ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণে (ডিএনসিসি) বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন, বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী একই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, অর্থবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালামের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সকালে গুলিস্তানের ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে ঢাকা দক্ষিণ আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনের রিটার্নিং অফিসার মিহির সারওয়ার মোর্শেদ এ তথ্য জানান। নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি এ কারণে তার মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। দক্ষিণে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া ২৬ জনের মধ্যে পিন্টু ছাড়াও ঋণখেলাপি হওয়ায় মো. বাবুল সরদার চাখারী এবং আয়কর রিটার্ন জমা না দেয়া মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।
গতকাল সকাল থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত মহানগর নাট্যমঞ্চের কাজী বশির মিলনায়তনে ঢাকা দক্ষিণে মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করা প্রার্থীদের মধ্যে কাদের মনোনয়ন বৈধ ও কারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন তা ধারবাহিকভাবে ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার মিহির সারওয়ার মোর্শেদ। প্রথমে মেয়র, পরে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ও সবশেষে সাধারণ কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনে যোগ্য ও অযোগ্যদের নাম ঘোষণা করেন তিনি। দক্ষিণে মেয়র পদে নির্বাচনে আগ্রহী ও মনোনয়নপত্র দাখিল করা ২৬ প্রার্থীর মধ্যে ২৩, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া ১৫৩ জনের মধ্যে ১২২ জনের মনোনয়ন বৈধ (৩১ জন অযোগ্য) বলে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৫৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে গতকাল ১২টি ওয়ার্ডে ১২০ প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ (১৫ জন অযোগ্য) ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণে মোট ৬৩২ প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। আজ সাধারণ কাউন্সিলর পদে বাকি ৪৫টি ওয়ার্ডের যোগ্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে। সকালে নিজের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আশা করি উৎসবমুখর পরিবেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী প্রার্থীদের মনোনয়ন বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপিপন্থি আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালকুদার বলেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে আমরা সন্তোষ্ট। পিন্টুর মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, তার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেননি। তিনি বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত কোন আসামি যদি আপিল করেন তাহলে তার দণ্ড বহাল থাকে না। তবে পিন্টু এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। আশা করি তার আপিল কমিশনে গ্রহণযোগ্য হবে।
দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে সম্মেলনে দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা প্রার্থীদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করেছি। তবে যাদের অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে তারা ৩ দিনের মধ্যে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বরাবর আপিল করতে পারবেন।

No comments

Powered by Blogger.