অস্থিতিশীলতার দ্বারপ্রান্তে by রাজা রুমি

জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে ঝরে গেছে শতাধিক জীবন। ধর্মঘটের কারণে ঢাকা প্রায় স্থির হয়ে গিয়েছিল, যে শহরটি বাংলাদেশের রাজধানী ও অর্থনীতির স্নায়ুকেন্দ্র। পেছন ফিরে দেখা যাক। পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি ছাপ রয়ে গেছে, যা মূলত রাজনীতিতে ঘন ঘন সামরিক হস্তক্ষেপ, বড় ধরনের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে আবর্তিত হওয়া অকার্যকর গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলার দরুন সৃষ্ট। বিপরীত মেরুতে অবস্থানরত দুই শিবিরের শীর্ষে রয়েছেন দুই নারী, যারা ‘বেগমস’ নামে পরিচিত। তারা হলেন আওয়ামী লীগের প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। আগেরজন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় বীর শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। দ্বিতীয়জন দেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। জিয়াউর রহমান আবার দেশের রক্ষণশীল অংশের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। ওই দুই দল, রাজনীতিবিদ ও তাদের শাসন থেকে নির্গত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি মাত্রা।
সাম্প্রতিক অস্থিরতার শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে। সে নির্বাচন বিরোধীদের বর্জন সত্ত্বেও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। উল্লেখযোগ্য বিরোধী দল বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামীর দাবি ছিল, দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। তবে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে একতরফা নির্বাচনী চর্চার দিকেই এগিয়ে যান হাসিনা, যার ফলে তিনি সহজেই আরেকবার ক্ষমতায় আরোহণ করেন।
নির্বাচন থেকে অস্থিরতার দিকে: গত ৫ই জানুয়ারি ছিল ২০১৫ সালের নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি। দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দেয় বিরোধীরা। সরকার বেশ শক্ত হাতে প্রতিক্রিয়া দেখায় বিরোধী কর্মীদের গ্রেপ্তার ও সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে। এর পাল্টা হিসেবে বিরোধীরা দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধ আহ্বান করে। সেই থেকে বিরোধীদের আন্দোলন ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাল্টা আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় নিজের কার্যালয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখে সরকার। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার গতিও ত্বরান্বিত করতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থনের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের ওপর মামলা ঝুলে আছে। এতে দলটিও রয়েছে বেকায়দায়। জানুয়ারি থেকে প্রায় ৭ হাজার বিরোধী কর্মী ও সমর্থকদের আটক করেছে পুলিশ। শতাধিক মানুষ রাজপথে সংঘর্ষে, পেট্রলবোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে প্রায় ২০ জনের মতো বিরোধী কর্মীকে বিচারবহির্ভূত উপায়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ খুবই উদ্বিগ্ন। সর্বশেষ এমন রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ২০০৭ সালে, যখন সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করেছিল। ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ নুরুল আমিন বলেন, উভয় শিবিরের কট্টরপন্থিরা কোন ছাড় দিতে রাজি নন। একই কথা বলছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সংস্থাটি বলছে, দলীয় স্বৈরাচারের মতো আচরণ করছেন দুই নেত্রী, যারা গোটা দেশকে দুটি যুদ্ধংদেহী শিবিরে বিভক্ত করছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, কিছু বিরোধী দলের কর্মীর সহিংস অপরাধের দরুন সরকারের হত্যাকাণ্ড, অন্যায়ভাবে আটক ও হতাহতের ঘটনাসমূহকে যৌক্তিকতা প্রদান করে না।
অর্থনৈতিক ও সরকারি দুর্দশা: বাংলাদেশের এ রাজনৈতিক হাঙ্গামার মধ্যে অবরোধ, সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে প্রতি বছর ২৪০০ কোটি ডলারের পোশাকশিল্পের ওপর। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) জানিয়েছে, পোশাকশিল্প ইতিমধ্যেই ৩৯০ কোটি ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অন্যদিকে খুচরা খাতের ক্ষতির পরিমাণ ২১০ কোটি মার্কিন ডলার। সম্প্রতি সপ্তাহে কৃষকরা নিজেদের পণ্য অবরোধের কারণে বিভিন্ন শহরে নিয়ে যেতে পারেননি। ফলে কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে ৫৩.৩ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান মুডিস দেশটির ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছে অব্যাহত রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে। দেশটি যে অর্থনৈতিক সফলতা অর্জন করেছে, তা আংশিকভাবে হারানোর ঝুঁকি রয়েছে, যদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। এ ছাড়া বর্তমান প্রবৃদ্ধি ছোট ঘাটতির দিকে রূপান্তরিত হতে পারে। গত কয়েক মাসে পরিবহন খাত বলতে গেলে বন্ধই ছিল। এর ফলে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও রপ্তানি কার্যক্রমও। গত দুই দশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক উন্নয়ন সূচকে উন্নতি করা সত্ত্বেও দেশটির রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা এখনও বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে। এটি এখনও কর্তৃত্বপরায়ণ, বংশানুক্রমিক ও ব্যক্তিচালিতই রয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই, সংসদ ও সুপ্রিম কোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অমার্যাদাই হয়ে উঠলো ফলাফল। বিরোধীদের অভিযোগ, আদালতও আওয়ামী লীগের বিশ্বস্তদের দিয়ে পূরণ করা হয়েছে গত ছয় বছর। সত্য কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে কেবল নিজেদের বিশ্বস্তদেরই নিয়োগ দিয়েছে। এর ফলে আমলাতন্ত্রেও দলীয় বিভাজন ঢুকে গেছে। বাংলাদেশের প্রয়োজন বড় ধরনের রাজনৈতিক ও সরকারি সংস্কার। এ ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনেও নতুন পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এর আগেরবার সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি বিধান ছিল, যেটি বর্তমান সরকার বিলুপ্ত করে দিয়েছে।
এরপর কি?: গত মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সহিংসতার ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পদ্ধতি দুই অহংচালিত নারীর কাছে জিম্মি, যাদের রয়েছে বিপুল সমর্থক। আরেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, সামরিক বাহিনী কোন হস্তক্ষেপ ছাড়া নীরবভাবে সবকিছুর দর্শক হওয়াটাই বেছে নিয়েছে। হাসিনার প্রথম মেয়াদে সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ করা হয়েছে।
দেশটিতে রাজনৈতিক সহিংসতার ধরন সুস্পষ্ট। সাধারণত নির্বাচনের আগে আগে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সহিংসতা মাত্রা ছাড়িয়েছে। এমনকি এখন আরও বৃহত্তর রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতিও এটি হুমকিস্বরূপ। হাসিনা সমপ্রতি খালেদার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছেন, তিনি সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় ফিরতে চান। তবে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দেন। অন্যদিকে বিরোধী দলের অভিযোগ, সহিংস কৌশল অবলম্বন করে সামরিক বাহিনীকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দিয়েছেন বরং হাসিনা। সরকারের কাছে যে একমাত্র অবশিষ্ট উপায়টি রয়েছে, তাহলো, রাজনৈতিক সংলাপের আয়োজন করা ও বিরোধীদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো। বর্তমান শাসক দলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ভারতেরও ঢাকাকে বিরোধীদের সঙ্গে রাজনৈতিক সহাবস্থানের উপায় খোঁজার পরামর্শ দেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় আরেকটি অচলাবস্থার সম্ভাবনা রয়েই যায়। বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়নও ঢাকার কর্তৃপক্ষকে বলতে পারে, রাজপথে লড়াইয়ের বদলে রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে। বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণে রাজনৈতিক পদক্ষেপের অনুপস্থিতি থাকলে, বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দ্বারপ্রান্তে থেকেই যাবে।
লেখক: ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির একজন ভিজিটিং ফেলো এবং দ্য ফ্রাইডে টাইমসের কনসাল্টিং এডিটর। গতকাল ফরেইন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ।

No comments

Powered by Blogger.