কাশ্মীরের অর্ধ-বিধবা ও বাংলাদেশে গুম by মীনাক্ষী গাঙ্গুলী

‘কে  উ একজন আমাকে জানিয়েছে, আপনারা সাহায্য করতে পারবেন। দয়া করে সাহায্য করুন, আমরা অসহায়।’ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে দুঃখজনকভাবে নিয়মিতই এমন আবেদন আসে। কিন্তু সবচেয়ে হিমশীতল বিষয় হচ্ছে,  যখন বলপূর্বক গুমের ব্যাপারে আমাদের সাহায্য চাওয়া হয়। হাসিনা আহমেদ আমাকে ফোন দিয়েছিলেন তার স্বামী ও বিরোধী দল বিএনপি’র রাজনীতিক সালাহউদ্দিন আহমেদের ব্যাপারে কথা বলতে। তাকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ২০১৫ সালের ১০ই মার্চ সন্ধ্যায়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, তখন তাকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্য পরিচয় দেয়া ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। হাসিনা আমাকে জানিয়েছেন, তিনি আরও অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা দেখেছে অপহরণকারীরা এসেছিল ভয়ঙ্করতম আধাসামরিক বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) গাড়িতে চড়ে। তবে সালাহউদ্দিনের হদিস সমপর্কে কোনকিছু জানা থাকার কথা, বা তার অন্তর্ধানের পেছনে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে সরকার। এটিই হচ্ছে বলপূর্বক গুমের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। প্রিয়জন হয়তো বহুবছর ধরে এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচে, আশা আর নিরাশার দোলাচলে। মায়েরা চিন্তিত থাকেন, তাদের সন্তান যদি কখনও ফেরেও, তাহলে তাকে চেনা যাবে কিনা। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে যেসব নারী তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বামীর খোঁজে এখনও অপেক্ষায় আছেন, তাদের বলা হয় ‘অর্ধ-বিধবা’। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার জানিয়েছে, তারা শোকও প্রকাশ করতে পারেন না ঠিকঠাকভাবে। তারা অস্থির থাকেন এই ভেবে যে, তাদের প্রিয়জন কি এখন নির্যাতন ভোগ করছে, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কবরে শায়িত হওয়ার মর্যাদা কি সে পেয়েছে? আজকের বাংলাদেশে, বহু পরিবার এমন প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে রয়েছে। গত ডিসেম্বরে, নিউ এইজ পত্রিকা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের গুমের ১৯টি ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পরিবারগুলো বলছে, সর্বশেষ তাদের দেখা গেছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাজতে। যাই হোক, সরকারি সংস্থাগুলো, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর হদিস সমপর্কে কোন তথ্য জানা থাকার কথা বা তাদের অপহরণে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। ওই একই মাসে, আইনমন্ত্রী তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারগুলো এখনও ওই তদন্তের ফলাফলের দিকে মুখ চেয়ে আছে। সালাহউদ্দিন আহমেদের গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলো তখন, যখন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে চলছে সহিংস লড়াই, যেটি শুরু হয়েছিল এ বছরের জানুয়ারিতে। এরপর থেকে ১৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, কয়েকশ’ আহত হয়েছেন। এদের বেশির ভাগই হতাহত হয়েছে বিরোধী দলের চাপিয়ে দেয়া হরতাল ও অবরোধ না মানতে গিয়ে। সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল, দেশব্যাপী হাজার হাজার বিরোধী কর্মীকে গ্রেপ্তার করা। হাসিনা আহমেদ বলেন, যদি আমার স্বামী কোন অপরাধ করে থাকে, তাকে শাস্তি দেয়া হোক। কিন্তু সে রীতিমতো হারিয়েই গেছে। আমি কীভাবে আমার ছেলেমেয়েকে বোঝাবো? তিনি বন্দীপ্রদর্শন পিটিশন দায়ের করেছেন আদালতে, কূটনীতিকদের কাছে লিখেছেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সাক্ষাৎ চেয়েছেন। কিন্তু তার ভাষায়, সরকার এসবকে পরোয়া করছে বলে মনে হয় না। অথচ, আন্তর্জাতিক আইনানুসারে বাংলাদেশ সরকার এসব পরোয়া করতে বাধ্য। বলপূর্বক গুমকে সংজ্ঞায়িত করা হয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক মানুষের স্বাধীনতাহানি হিসেবে। বলপূর্বক গুম প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। একই সঙ্গে, নির্যাতনের উপর নিষেধাজ্ঞা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক হওয়া থেকে মুক্ত থাকা সহ একাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘণ করা হয় বলপূর্বক গুমের মাধ্যমে। নিজে যখন বিরোধী দলে ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান গুমের চর্চা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি নিজে নির্বাচিত হলে এ পদ্ধতির সংস্কার করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বিরোধীদের বর্জনের পর, নিজের টানা দ্বিতীয় মেয়াদে নিরঙ্কুশ আধিপত্য ভোগ করছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াটা বেছে নিতে পারেন, তদন্ত করতে পারেন গুমের ঘটনাগুলোর, একই সঙ্গে জড়িতদের মুখোমুখি করতে পারেন বিচারের। এর শুরু হিসেবে তিনি দেখা করতে পারেন তার মিতা হাসিনা আহমেদের সঙ্গে, এবং তার স্বামীর হদিস খুঁজে বের করতে স্বাধীন তদন্তের ঘোষণা দিতে পারেন।
(মীনাক্ষী গাঙ্গুলী মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক)
(গতকাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.