অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ by মঈন উদ্দিন খান

রাজনৈতিক অস্থিরতায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। মরছে মানুষ, পুড়ছে যানবাহন। বোমা হামলা হচ্ছে বিচারালয় থেকে মন্ত্রীদের বাড়িতে। গুলি এখন আন্দোলন দমনের প্রধান হাতিয়ার। বলপ্রয়োগের বিপরীতে পাল্টা বলপ্রয়োগ। বিরোধী মত বলতে কিছুই নেই। সাধারণ মানুষ পার করছে অনিশ্চিত জীবন। তারপরও জবরদস্তি শাসন যেমন দিনকে দিন বেপরোয়া হচ্ছে। তেমনি অবরোধ ও হরতালে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। রক্তাক্ত এই পর্বের সমাপ্তি কিভাবে হবে, তা যেন কারোরই জানা নেই। কেউ অদৃষ্টে, কেউ সমাধান দেখছেন পাল্টা শক্তি প্রয়োগের মধ্যে। ইতোমধ্যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা টার্গেট হয়েছেন।
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে গুলি করে আহত করা হয়েছে। তার গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
রিয়াজ রহমানের ওপর এই হামলা দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। একজন পণ্ডিত ও পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। এ ঘটনার পর সুশীল সমাজের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি চেষ্টা করা হচ্ছে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের। মাঠের আন্দোলনের খবর ও ছবি এড়িয়ে যাচ্ছে সংবাদপত্র ও টেলিভিশিনগুলো। আরেকটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হওয়ার পর গণমাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
‘৫ জানুয়ারি ২০১৪’ বাংলাদেশকে চলমান এই অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিন আরেকটি কলঙ্ক যোগ হয়েছে। একতরফা একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেছে আওয়ামী লীগ। সেই দিনকার সহিংসতা ছিল নজিরবিহীন। রক্তের পথের ওপর দাঁড়িয়ে গুনতে হয়েছে কিছু জায়গায় নির্বাচনের ফল। বিরোধী দলগুলোর তুমুল আন্দোলনে জনগণ নির্বাচনমুখী হয়নি। কারো মতে ৫ শতাংশ, কারো মতে ১০ শতাংশ ভোট পড়েছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে।
ওই নির্বাচনের আগে সারা দেশে তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে চাপ ছিল বহির্বিশ্বের। কিন্তু কোনো আলোচনাই ফল দেয়নি। নির্বাচন হয়েছে। ১৫৩ আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, সরকারে অংশ নেয়া বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার কেউই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। এরকম একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদও সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কার্যকর বিরোধী দল নেই। যে দল আছে তারা সরকারেরও ভাগিদার, ছাপোষা।
এরকম একটি নির্বাচনের পরও বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি এক বছর ধরে নতুন আরেকটি নির্বাচনের দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে। সরকারের কাছে বারবার আহ্বান জানিয়েছে সংলাপের টেবিলে বসার। কিন্তু এক বছর পার হওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা শক্তিশালী সরকার আলোচনার আহ্বান উড়িয়ে দেয়। পূর্ণ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন দেয়ার কথা বলে।
বিএনপির অবস্থান দুর্বল ভেবে সরকারের এই ‘একগুঁয়ে’ নীতি নতুন করে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল আবারো আন্দোলনে। অবরোধ, হরতাল, অসহযোগ নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে। দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল আন্দোলন।
দ্বিতীয় পর্বের এই আন্দোলনের পথও সরকার করে দিয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে অর্থাৎ গত ৫ জানুয়ারি বিরোধী জোট রাজধানীতে একটি বড় সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু অজানা ভয়ে সরকার সেই সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়েছে। রাজনীতিতে নতুন দমন কৌশল ‘বালুর ট্রাক’ নীতি অবলম্বন করেছে তারা। সমাবেশ করতে অনড় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয় ঘিরে সরকার পুলিশি বেষ্টনী তৈরি করে। ডজনখানেক ইট-বালুভর্তি ট্রাক রেখে কার্যালয়ের ভেতরে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়, যা এখনো চলছে।
অবরুদ্ধ অবস্থা প্রত্যাহার না হওয়ায় ও সমাবেশ করতে না দেয়ার প্রতিবাদে এখন দেশজুড়ে আন্দোলন চলছে। লাগাতার অবরোধ, হরতালের ডাক দেয়া হয়েছে। এর ফলে কার্যত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে রাজধানী। যোগাযোগব্যবস্থা সচল করতে সরকারের কোনো উদ্যোগ সফল হচ্ছে না। রেল চলাচল বিপর্যস্ত। সড়কপথে চলছে না দূরপাল্লার কোনো বাস। পণ্য পরিবহন প্রায় বন্ধ। জিনিসপত্রের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নাগরিক জীবন পড়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। রাজধানী ঢাকা সন্ধ্যার পর ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করছে। যেন রাতের ঢাকায় চলছে কারফিউ। দিনের বেলায়ও অনিশ্চয়তা। ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রয়েছে।
চলমান আন্দোলন লাগাতার রাখতে নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোচ্ছে বিএনপি। অবরোধ রেখেই ঢাকায় আবারো সমাবেশের চিন্তাভাবনা চলছে। দলের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, কৌশলী কর্মসূচি দিয়েই সরকারকে অব্যাহতভাবে চাপে রাখতে হবে। ঢাকায় ২০ দলকে সমাবেশ করতে না দিলে আবারো সিরিজ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বিএনপির চলমান আন্দোলনে বাড়ছে রাজনৈতিক মিত্র। অল্প সময়ের মধ্যে মাঠে নামছে রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম এমন বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা এ দলগুলো ইতোমধ্যে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সোচ্চার হয়েছে। নিজ নিজ দলীয় পরিমণ্ডলের বাইরে এখন তারা মনোযোগী হচ্ছেন জোটগত আন্দোলনে। লক্ষ্য একই দ্রুত সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন নিশ্চিত করা। বিএনপির হাইকমান্ডও আন্দোলন ‘ঐক্যবদ্ধভাবে’ এগিয়ে নিতে এসব দলের সাথে নিত্য যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা, ড. কামালের গণফোরাম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আব্দুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের দাবিতে সোচ্চার। প্রতিটি দলই মনে করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার পরিবর্তে ‘একতরফাভাবে’ হয়েছে। এর ফলে যে রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়েছে, নতুন নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত তা নিরসন হবে না। এই পটভূমিতে বিএনপির চলমান আন্দোলনের সাথেও তারা একমত।
দ্রুত নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির শীর্ষ চার নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায়, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মোবিন চৌধুরী ও উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু।
বিএনপি সূত্রগুলো বলছে, নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করে আন্দোলন পরিকল্পনা সামনে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশ থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা চলছে। পরিস্থিতি বুঝে রাজধানীতে আন্দোলন কঠোর করা হবে।
দলের নেতারা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। দিন যত যাবে তীব্রতা তত বাড়বে। আর ঢাকায় তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করবে। দাবি আদায়ে সফলও হবে বিএনপি।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সঙ্ঘাত এড়িয়ে সমঝোতার পথে ফিরে আসতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন।
বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) সভাপতি অমিত শাহ ফোন করে অসুস্থ খালেদা জিয়ার খোঁজখবর নেয়ার বিষয়টিও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
আন্দোলন চললেও নতুন নির্বাচন নিয়ে কার্যকর যেকোনো আলোচনায় সাড়া দেবে বিএনপি। সমঝোতার দরজা খোলা রেখেই তারা টানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি নেতারা গত চলমান আন্দোলন ও প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ভূমিকায় আন্দোলনের সফলতা নিয়েও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তাদের বিশ্বাস আলোচনার দিকে না এগোলে সরকার খুব কম সময়ের মধ্যে আরো বেশি চাপের মধ্যে পড়বে।
সরকার আন্দোলন দেখে ইতোমধ্যে বিচলিত হয়ে উঠেছে। সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি চেষ্টা করছে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের। মাঠের আন্দোলনের খবর ও ছবি এড়িয়ে যাচ্ছে সংবাদপত্র ও টেলিভিশিনগুলো। আরেকটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হওয়ার পর গণমাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অপর দিকে কয়েকটি টেলিভিশন সরাসরি প্রপাগান্ডায় লিপ্ত হয়েছে।
সরকারের মন্ত্রীরাও বলছেন কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করা হবে। কিন্তু নিপীড়নমূলক শাসনের শেষ হয় রক্তাক্ত পরিণতির মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ এখন এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.