গোয়া এবং তারপর ... by আলী যাকের

দক্ষিণ গোয়ার ভাস্কো দা গামা স্টেশনে ট্রেনটি এসে পৌঁছল সন্ধ্যা ৬টায়। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এখানেই রাতটা কাটাতে হবে; কেননা ভাস্কো থেকে গোয়ার রাজধানী পানাজিতে যাওয়ার কোনো পরিবহন সেই সময় পাওয়া যাবে না। স্টেশনে খবর নিয়ে জানলাম যে, কাছে-ধারেই একটা মাঝারি গোছের হোটেল আছে। নাম 'সুপ্রিম'। অতএব, আমরা সাড়ে তিনজন মালপত্র নিয়ে দুটি রিকশা করে হাজির হলাম হোটেলে। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, সম্প্রতি ইন্টারনেট সূত্রে জানতে পারলাম যে ভাস্কোতে এখনও এই হোটেলটি আছে এবং অতি সস্তা মূল্যে এখানে থাকা যায়। যেমন, ভারতীয় দেড় হাজার রুপিতে একটি ডাবল রুম পাওয়া যায় এখন। ১৯৮০-তে কত রেট ছিল এখন মনে পড়ছে না। হোটেলে চেকইন করে রাত ৯টার দিকে খাবারের সন্ধানে বের হলাম। রিসিপশন থেকে বলা হলো, এই হোটেল থেকে অল্প দূরেই একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁ রয়েছে। আমাদের সবার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সাড়ে তিন বছরের ইরেশ পর্যন্ত খুশির চোটে ফ্যাক করে হেসে দিয়ে লাফিয়ে উঠল। আমরা দ্রুতগতিতে হেঁটে পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেস্তোরাঁয় পেঁৗছে গেলাম। খুবই ছোট রেস্তোরাঁ। খাবার ঢাকার মতোই চিরায়ত ভারতীয় চাইনিজ। মনে আছে আমরা সাড়ে তিনজন ছয় রকমের ছয়টি ডিশ সাবাড় করে দিলাম। তারপর আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর যখন তুলছি হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে ইরেশ বলে উঠল, 'বাবা, এতদিনে পেট ভরল'। এই পর্যন্ত দক্ষিণ ভারত সফরে আসার পর সবচেয়ে ভালো ঘুম হলো সেই রাতে।
পরদিন সকালে একটি ট্যাক্সিতে করে আমরা পানাজির উদ্দেশে রওনা দিলাম। ভাস্কো থেকে পানাজি ৩৩ কিলোমিটার পথ। কিন্তু পাহাড়ি পথে স্বভাবতই দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো সম্ভব নয় বলে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। পথটি সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে। ভারি মনোরম। গোয়ার রাজধানী পানাজি ছোট্ট সুন্দর একটি শহর। একাধিক দর্শনীয় স্থান আছে এখানে। শহরের মধ্যখানে প্রায় পুরোটাজুড়েই একটি বাজার, অনেকটা আমাদের দেশের বাণিজ্য মেলার মতো বিন্যস্ত। এখানকার লোকজন, বিশেষ করে নারীরা সর্বদাই হাসিমুখে শপিং করে বেড়াচ্ছে। আমরা যেদিন সকালে পানাজিতে এলাম সেদিন খ্রিস্টানদের 'লেন্ট' উৎসব চলছিল। পানাজিতে হাজার হাজার পুরুষ-রমণী তাদের আকর্ষণীয় পোশাক-পরিচ্ছদে আবৃত হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। এখানকার সব রাস্তার মোড়ে লাউড স্পিকার লাগিয়ে নানা রকম ইংরেজি গান বাজানো হচ্ছে। সবাই সেই সুর এবং ছন্দে নেচে নেচে পথ চলছে। আমরা এ বাজারেরই একটা ছোট্ট হোটেলে আমাদের মালপত্র রেখে বেরিয়ে এলাম পানাজির মানুষের সঙ্গে নেচে-গেয়ে দিনটা পার করে দেব বলে।
এখানে দু'দিন থাকব। আজকের রাত থেকে কাল সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে যাব ভাস্কোতে। ওই রাতেই সেখান থেকে আমাদের ট্রেন। অতএব, আজকের এই 'লেন্ট' উৎসবের দিনে শহর এবং আশপাশ দেখেই কাটাব সারাদিন। কালকের জন্য রাখা থাকল গোয়ার অতি আকর্ষণীয় সমুদ্রসৈকতগুলো। সৈকতে আমাদের গন্তব্য হবে অর্জুন এবং কালাংগুট বিচ। পানাজির অদূরেই পুরনো গোয়া নামে একটি উপশহর আছে। যেটি পর্তুগিজদের প্রথম উপনিবেশ ছিল এবং যেখানে প্রতিদিন প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটে। পুরনো গোয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিজাপুরের সুলতানদের দ্বারা ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এইটিই ছিল গোয়ার রাজধানী। এ সময়ে পুরনো গোয়া আক্রান্ত হয় প্লেগ মহামারীর দ্বারা এবং এখানকার অধিবাসীরা শহরটি থেকে পালিয়ে গিয়ে গোয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট উপশহর নির্মাণ করে। পুরনো গোয়ায় বেসিলিকা গির্জায় একটি কাচের কফিনের ভেতরে রক্ষিত আছে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়েরের মমিকৃত দেহ। মেঝে থেকে একটু ওপরে স্থাপিত এই কাচের কফিনটির মধ্যে সেন্ট ফ্রান্সিসের মুখটি স্পষ্ট দৃশ্যমান। আমরা সবাই প্রথম দর্শনেই শিহরিত এবং মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
পরের দিন সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম সকাল ৭টায়। এরই মধ্যে নাশতা করা হয়েছিল। প্রথমে কালাংগুট। ইরেশ তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছিল। তাই প্রাতঃকৃত্য শেষ করা হয়নি তার। এখানে একটি বাবলা গাছের তলায় সেটি সারা হলো। এটি নিয়ে ও নিজেই একটি গান বেঁধেছিল এবং সেটি প্রায়ই গাইত। 'এই তো বেশ এই, কালাংগুটের বাবলা গাছের নিচে...!' অর্জুন সৈকতে নারী-পুরুষের নগ্ন দেহের ভিড় দেখে আমরা সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম।
ওইদিনই রাতে ভাস্কো থেকে আমরা ট্রেনে চেপে বসলাম। গন্তব্য বোম্বে, বর্তমানের মুম্বাই। ভাস্কো থেকে মেইল ট্রেনটি ছাড়ে বোম্বের উদ্দেশে রাত ১০টায়। আমরা গুছিয়ে-গাছিয়ে বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। সকাল ৮টায় এই গাড়ি বোম্বে পেঁৗছবে। ঘুম যখন ভাঙল তখন ট্রেনটি আস্তে আস্তে বোম্বের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। নূর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ট্রেনের দু'দিকে। সেখানে রেললাইনের দু'ধারে বসে সারিবদ্ধ মানুষ তাদের ভোরের প্রথম কাজটি সারছে। সকাল সোয়া ৮টায় ট্রেন বোম্বের গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে এসে থামল। আমরা মালপত্র নিয়ে নেমে এলাম। গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের বাইরে এসে দেখি এই বিশাল শহরের প্রাত্যহিক কাজকর্ম ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। প্রতি মিনিটে একটি করে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীবাহী ট্রেন এসে প্লাটফর্মে দাঁড়াচ্ছে। ভেতরের মানুষ বেরিয়ে এসে ছুটছে রুদ্ধশ্বাসে যার যার গন্তব্যে। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি। ইতিহাসের সাক্ষী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের নিদর্শন এই গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল। নিজস্ব গরিমায় স্নাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বলছে, এই দেখ আমাকে। প্রাণচঞ্চল বোম্বের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আমি তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি। অস্ফুটে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, 'গুড মর্নিং বোম্বে'।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.