দগ্ধদের সেবক মণি খালার গল্প... by মানসুরা হোসাইন

(দুর্ঘটনায় পুড়ে গিয়েছিল মণি বিবির মুখ-হাত। পোড়ার যন্ত্রণা তাই ভালো করেই বুঝেন তিনি। সেই উপলব্ধি থেকে এখন কাজ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে, বিনা বেতনে। ছবি: মনিরুল আলম) ‘পুড়ার যন্ত্রণা আছে বইন। বহুত যন্ত্রণা। আমার মুখ আর হাত পুড়ছে, তাই যে যন্ত্রণা! আর যাগোর সারা শরীল পুড়ছে, তাগোর যে কী যন্ত্রণা তা আমি বুঝি। তাই ড্রেসিং করার সময় রোগীরে ব্যথা দিই না। বাবারে, সোনারে কইয়া ডাকি। আমি যে রোগীর ড্রেসিং করি, সেই রোগী চিক্কুর দেয় না।’ কথাগুলো বলছিলেন মণি বিবি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে সবার কাছে তিনি মণি খালা হিসেবেই পরিচিত। তাঁর সঙ্গে বার্ন ইউনিটের সম্পর্ক ২০০৩ সাল থেকে, বলতে গেলে বার্ন ইউনিটের জন্ম থেকেই। আগুনে পুড়ে মণি বিবির মুখ, বুক, দুই হাত দগ্ধ হয়। তখন তিনি এখানে এসেছিলেন রোগী হিসেবে। এখন তিনি অন্য রোগীদের ড্রেসিং করানো, নাশতা এনে দেওয়া, অক্সিজেন সিলিন্ডার এগিয়ে দেওয়া, রোগীর ট্রলি ঠেলে নেওয়াসহ বহু কাজ করেন। অনেক সময় রোগী মারা গেলে তাঁর গোসলও করান তিনি। বলতে গেলে তাঁর দিন-রাত কাটে এখানেই। দগ্ধ হয়ে মণি বিবির নাক ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। মুখ বেঁকে গেছে। দুই হাত বেশ খানিকটা কুঁকড়ে গেছে। দুই চোখে আবার দেখতে পাবেন, তা চিন্তাও করতে পারেননি। সেই তাঁর এখন দম ফেলার ফুসরত নেই। তিনিসহ মোট ৭৫ জন বার্ন ইউনিটে কাজ করছেন বিনা বেতনে। মাঝখানে দুই বছর কিছু বেতন পেয়েছিলেন, তবে এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। আজ সোমবার সকালে বার্ন ইউনিটে গিয়ে মণি বিবির খোঁজ করতেই খোঁজ মিলল ড্রেসিং রুমে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ-হরতালের সময় নাশকতায় দগ্ধ রোগীদের ড্রেসিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। জানালেন, রাতে নাইট ডিউটি করে দুপুর হয়ে গেলেও সকালের নাশতা খাওয়ার সময় পাননি। এ ছাড়া দগ্ধ রোগীদের ড্রেসিং করার পর খেতেও পারেন না সেভাবে। একেবারে বাসায় ফিরে ভাত খান। মণি বিবি ওয়ার্ডে রোগীর স্বজনদের ভিড় দেখেই গজগজ শুরু করলেন, ‘এখানে এত ভিড় কিসের? বের হন, বের হন। এই রোগীর ইনফেকশন হইব না তো কার হইব?’ একজন নার্স অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে বললেন। শুনেই তিনি ছুটলেন। মণি বিবি বললেন, ১২ বা ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। এখন বয়স কত তা তাঁর জানা নেই। তিনি কীভাবে পুড়েছিলেন, সে ইতিহাসের ভেতর ঢুকে গেলেন। বললেন, ‘তখন মাইয়্যা মাত্র বওয়া (বসা) শুরু করছে। জামাই মারছিল। তাই রাগ কইরা কয়দিন ভাত খাই নাই। ধান সিদ্ধ কইরা বড় পাতিল কেবল নামাইছি। মাথাডা ঘুইরা গেল। গিয়া পড়লাম চুলার মধ্যে। স্বামীই এই মেডিকেল ভর্তি করাইল। জামাই আমারে ফালাইয়া গেছে গা। পরে ভাইরা চিকিৎসা করায়।’
মণি বিবির স্বামী আর তাঁকে ঘরে নেননি। স্বামী আবার বিয়ে করেছিলেন। তবে দুই ছেলে ও এক মেয়ের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ঘাড়েই। দুই ছেলে এখন দরজির কাজ করে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের ঘরে পাঁচ বছরের নাতিও আছে। রাজধানীর হোসনি দালানের কাছে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মণি বিবি তাঁর দুই ছেলে নিয়ে থাকেন। তাঁর ভাষায়, ‘আল্লাহর ৩০ দিনই কাটে বার্ন ইউনিটে। ঈদের দিনও।’ রোগীর স্বজনেরা খুশি হয়ে যা দেন, তাই দিয়ে চালাতে হয় সংসার। তাঁর বাড়ি শরীয়তপুরে। জানালেন, কারও কাছে হাত পেতে কিছু চান না, লজ্জা লাগে। আর হরতাল-অবরোধে নাশকতার শিকার রোগীদের কাছে তো কিছু চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। হরতাল-অবরোধের কারণ কী? জানতে চাইলে মণি বিবির কণ্ঠে ক্ষোভ জমে। তিনি বলেন, ‘দুই জনের পাল্লাপাল্লিতে দেশের লাখ লাখ মানুষ মরতাছে। দেশটারে কানা কইরা দিতাছে। দুইজনরে কই, আপনেরা হ্যান্ডশেক কইরা একসঙ্গে বন (বসেন)।’ হরতাল-অবরোধের কারণে মণি বিবির মনে অজানা আশঙ্কা কাজ করে। দুই ছেলে কাজের জন্য ঘর থেকে বের হয়। সেদিনই ছেলে যে জায়গায় কাজ করে সেখান থেকে একজন দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়। তিনি বলেন, ‘ছেলেরে ফোন দিয়া কাছে আনছি। তারপর শান্তি। মা বাইচ্যা থাকতে যদি পুলা মইরা যায়, তার মতোন কষ্ট আর কী আছে। কতজনের পুলা, ভাই মরতাছে। একজন কইরা ভর্তি হয় আর চাইয়্যা দেহি। মনে হয়, এর চেহারাও তো আমার ভাই বা পুলার মতন।’
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক, নার্সদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন মণি বিবি। বিশেষ করে বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সামন্ত লাল সেনের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মণি বিবি বলেন, ‘সেন স্যাররাই তো আমার চিকিৎসা করছে। একটা টাকাও লাগে নাই অপারেশন করাইতে। তারপর এখনো অনেক আদর করে।’ বার্ন ইউনিটের যে রোগীরা ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে যান, তারাও হাসপাতালে ফলোআপে এলে একবার হলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করে যান। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মণি বিবিসহ অন্যরা বিনা বেতনে কাজ করছেন। সবার মধ্যে মণির ঘটনাটা একটু অন্য রকম। তাঁর জন্য কিছু করা যায় কি না, তার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

No comments

Powered by Blogger.