নিখোঁজ মানুষ by পাত্রিক মোদিয়ানো

আমি কিছুই না। সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাফের ছাদ-বারান্দার গায়ে ছায়া হয়ে থাকা সেই এক আবছা আকৃতি ছাড়া আর কিছুই না আমি। তখন আমি অপেক্ষা করছি যে বৃষ্টি কখন থামবে; বৃষ্টিটা শুরু হয়েছিল হুট্টে আমাকে ফেলে চলে যাওয়ার পরই।  এর কয়েক ঘণ্টা আগে আমরা আবার একবার শেষবারের মতো দেখা করেছিলাম এজেন্সির অফিসে। হুট্টে, বরাবরের মতো বসে ছিল তার বিশাল ডেস্কে, তবে কোট গায়ে চাপিয়েই। এর ফলে পুরো জিনিসটার মধ্যে সত্যি একটা বিদায়ের আবহ তৈরি হয়েছিল। আমি বসেছিলাম তার উল্টো দিকে, আমাদের ক্লায়েন্টদের জন্য রাখা হাতলওয়ালা এক লেদারের চেয়ারে। নানা রং ছড়ানো বাতিটা থেকে উজ্জ্বল আলো বের হয়ে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। ‘তো, গাই, তাহলে আজকের দিনটাই শেষমেশ এসে গেল...এখানেই তাহলে ইতি’, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল হুট্টে। ডেস্কে পড়ে আছে একটা দলছুট ফাইল। মনে হয় ওটা সেই কালোমতো ছোটখাটো লোকটার হবে, সেই যে ভয়-পাওয়া চেহারার, ফোলা ফোলা গালের লোক যে আমাদের ভাড়া করেছিল তার বউকে অনুসরণ করার কাজে। পরে বিকেলের দিকে ওই মহিলা পল-দুমার অ্যাভিনিউয়ের কাছে ভিতাল রোডের এক আবাসিক হোটেলে দেখা করল আরেক কালোমতো ছোটখাটো লোকের সঙ্গে,
তারও চেহারা ছিল ফোলা ফোলা ধরনের। চিন্তার মধ্যে ডুবে হুট্টে তার দাড়িতে হাত বোলাতে লাগল। খুব ঘন করে ছাঁটা ধূসরবর্ণ দাড়ি তার দুই গাল বেয়ে ছড়িয়ে গেছে। আর তার বড় স্বচ্ছ চোখ দুটো স্বপ্নালুভাবে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ডেস্কের বাঁ পাশে একটা বেতের চেয়ার, কাজের সময় যেটাতে আমি বসি। হুট্টের পেছনে কাঠের কালো তাকগুলো দেয়ালের অর্ধেকটা দখল করে আছে। ওখানে সারি করে রাখা গত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের রাস্তাঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বহু ডাইরেক্টরি আর যত ধরনের সম্ভব ইয়ারবুক। হুট্টে আমাকে প্রায়ই বলত যে আমাদের কাজের জন্য অতি প্রয়োজনীয় জিনিস এগুলো, বলত যে সে কোনো দিন এদের থেকে বিদায় নেবে না। আর এই ডাইরেক্টরিগুলো, এই ইয়ারবুকগুলো আসলে আপনার পক্ষে কল্পনা সম্ভব এমন—সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে আবেগ-জাগানো এক লাইব্রেরিই বটে—এদের পাতার পর পাতায় তালিকা করা আছে কত মানুষের, কত জিনিসের, কত হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর; সেসবের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে কেবল ওই তালিকাগুলোই। ‘এই এত এত ডাইরেক্টরি নিয়ে এখন কী করবে তুমি?’ আমি তাকগুলোর দিকে সাঁ করে একবার পুরো দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তাকে। ‘ওগুলো আমি এখানেই রেখে যাচ্ছি, গাই। এই অ্যাপার্টমেন্টের লিজ আমি ছেড়ে দিচ্ছি না।’ সে এবার চারদিকে তাকাল একটা চকিত দৃষ্টি দিয়ে। পাশের ছোট ঘরটাতে যাওয়ার জোড়া দরজা খোলা ছিল; ওখান দিয়ে দেখা যাচ্ছিল বহু-ব্যবহৃত ভেলভেটে মোড়া সোফা, ফায়ারপ্লেস আর আয়নাটাকে—আয়নার ভেতরে ইয়ারবুক, ডাইরেক্টরির সারিগুলো আর হুট্টের মুখ। প্রায়ই আমাদের ক্লায়েন্টরা এই ঘরে বসে অপেক্ষা করে। ওখানে নকশাকাটা কাঠ দিয়ে তৈরি মেঝেটাকে সুরক্ষা দিচ্ছে একটা পারস্যের কার্পেট। দেয়ালে, জানালার কাছে ঝুলছে একটা মূর্তি।
‘গাই, কী ভাবছ তুমি?’
‘কিছু না। তো, তুমি তাহলে অ্যাপার্টমেন্টটা ছাড়ছ না?’
‘হ্যাঁ। মাঝেসাঝে আমি প্যারিস আসব, তখন এই এজেন্সির অফিস হবে আমার সাময়িক আবাস।’
সে তার সিগারেট কেসটা বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে।
‘আমার মনে হয় এই অফিসটা যেমন আছে তেমনভাবে রেখে দিলেই বরং দুঃখ কম লাগবে।’
আমরা দুজন একসঙ্গে কাজ করছি আজ আট বছরেরও ওপরে হবে। হুট্টে নিজে এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি চালু করে ১৯৪৭ সালে; আর আমার আগে আরও বেশ কজন লোকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তার। আমাদের ব্যবসাটা হচ্ছে, হুট্টের মতে, ক্লায়েন্টদের ‘সোসাইটি ইনফরমেশন’ সরবরাহ করা। এর সবই হলো—যেমনটা হুট্টে বারবার বলতে পছন্দ করত—সোসাইটির, মানে একটু ওপরতলার লোকজনের মধ্যেকার ব্যাপারস্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করা।
‘তোমার কী মনে হয়, তুমি নিস-এ থাকতে পারবে?’
‘অবশ্যই পারব।’
‘বোর হয়ে যাবে না?’
সে ফুঁ দিয়ে খানিকটা ধোঁয়া ছাড়ল।
‘গাই, মানুষকে একদিন না-একদিন তো অবসরে যেতেই হবে।’
বিশাল দেহটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল হুট্টে। তার উচ্চতা নিশ্চিত ছয় ফুটের বেশি, আর ওজন অবশ্যই ২০০ পাউন্ডের ওপরে হবে।
‘আমার ট্রেন ১০টা ৫৫ মিনিটে। একটা ড্রিংক করার মতো সময় হাতে আছে আমাদের।’ সে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে করিডরে গিয়ে ঢুকল। এই করিডরটা গেছে অফিসে ঢোকার মুখের হলঘরের দিকে, এক বেঢপ গোল-মতোন ঘর যার দেয়ালগুলো আবছা-ধূসর রঙের। একটা কালো ফোলিও ব্যাগ, ওটা কাগজপত্রে এত ঠাসা যে বন্ধ হচ্ছে না, পড়ে আছে মেঝেতে। হুট্টে ফোলিওটা হাতে তুলল, তারপর তার এক হাত ওটার নিচে দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে চলল।
‘তোমার লাগেজ নেই কোনো?’
‘সব আমি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি।’
হুট্টে এবার সামনের দরজা খুলল, আমি হলঘরের বাতি নিভিয়ে দিলাম। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দরজা বন্ধ করার আগে সে থামল এক মুহূর্ত; তারপর দরজা আটকানোর ধাতব শব্দটা আমাকে ফেলে দিল এক গভীর বেদনার মাঝে। এই শব্দ ইতি ঘোষণা করল আমার জীবনের এক দীর্ঘ অধ্যায়ের।
‘জীবনের এই ব্যাপারগুলো চরম কুৎসিত, তাই না গাই?’ বলল হুট্টে, আর তার কোটের পকেট থেকে বের করল বড় একটা রুমাল, ভুরু মুছল তা দিয়ে।
কালো মার্বেলের আয়তাকার ফলকটা, এর অক্ষরগুলো গিল্টি করা
আর চকচকে একটা জিনিস দিয়ে সেগুলোর ওপরভাগ মোড়ানো, তখনো লাগানো রয়েছে ওখানে: সি. এম. হুট্টে, প্রাইভেট এনকোয়ারিজ।
‘আমি এটা এখানেই রেখে যাচ্ছি,’ বলল হুট্টে, তারপর তালার মধ্যে চাবি ঘুরাল।
আমরা নিয়েল অ্যাভিনিউ ধরে একদম প্লেস পেরেইরে পর্যন্ত চলে গেলাম। বাইরে তখন অন্ধকার, আর শীতকাল যদিও আসতে খুব বেশি বাকি নেই, তবু আবহাওয়া বেশ সহনীয়ই ছিল বলতে হয়। প্লেস পেরেইরে পৌঁছে আমরা হোরটেনসিয়াস ক্যাফের ছাদের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। এই ক্যাফেটা হুট্টে পছন্দ করে কারণ এর চেয়ারগুলো বেতের—‘ঠিক আগেকার দিনের মতো।’
‘তা এবার তোমার ব্যাপারে বলো গাই, তুমি কী করবে বলে ঠিক করেছ?’ ব্র্যান্ডি ও সোডার কয়েক ঢোক খেয়ে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল সে।
‘আমি? আমি একটা জিনিসের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
‘খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছ মানে?’
‘হ্যাঁ। আমার অতীতের।’
কথাটা মনে হয় একটু অদ্ভুতভাবেই বলে ফেললাম আমি; শুনে মুখে একটু হাসি ফুটল হুট্টের।
‘আমি অবশ্য সব সময়ই ভাবতাম যে একদিন না-একদিন আবার তুমি তোমার অতীত খোঁজার চেষ্টা চালাবে।’
এবার হুট্টে সিরিয়াস হয়ে গেল, তার কথা নাড়া দিল আমাকে।
‘কিন্তু কথা শোনো, গাই। আমি জানি না ওই অতীত খোঁজার কোনো অর্থ হয় কি না।’
চুপ হয়ে গেল সে। কী ভাবছে সে? তার নিজের অতীতের কথা?
‘আমি তোমাকে এজেন্সি অফিসের একটা চাবি দিয়ে যাচ্ছি। তাহলে মাঝেমধ্যে তুমি ওখানে যেতে পারবে। আমার সেটাই ভালো লাগবে।’
সে তার হাতে একটা চাবি বাড়িয়ে ধরল, আমি ওটা রাখলাম আমার ট্রাউজারের পকেটে।
‘আর নিস-এ আমাকে কল কোরো। আমাকে খবরাখবর জানিয়ো, জানিয়ো যে তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে...মানে তোমার অতীত খোঁজার বিষয়টা...।’
উঠে দাঁড়াল সে, আমার হাত জড়িয়ে ধরল।
‘আমি কি তোমার সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত যাব?’
‘না, না...দুঃখ বাড়বে তাতে...।’
একটা বড় পা ফেলে সে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে, একবারও পেছনের দিকে ঘুরল না। আমি হঠাৎ একধরনের শূন্যতা অনুভব করলাম। এই লোকটা আমার জীবনে অনেক তাৎপর্যবহ এক লোক। আমি ভাবি যে তাকে ছাড়া, তার সাহায্য ছাড়া ওই ১০ বছর আগে কী অবস্থা হতে পারত আমার, যখন আমি পুরোপুরি স্মৃতি হারিয়ে অন্ধের মতো হাতড়ে ফিরছিলাম এক কুয়াশার মধ্যে। আমার ঘটনা তার মনকে নাড়া দিয়েছিল এবং তার যে লোকজন অনেক চেনাজানা সে ব্যাপারটার সাহায্য নিয়ে সে এমনকি আমার জন্য বৈধ পরিচয়পত্র ইত্যাদি জোগাড় করে দিতেও সক্ষম হয়েছিল। ‘এই নাও’, সে আমার হাতে একটা বড় খাম তুলে দিতে দিতে বলেছিল সেই দিন, ওটার ভেতরে ছিল একটা পরিচয়পত্র আর একটা পাসপোর্ট। ‘তোমার নাম এখন থেকে গাই রোঁল্যা।’ আর এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভদ্রলোক—যার পেশাদারি সেবার সহযোগিতা আমাকে বারবার নিতে হয়েছে, যখনই আমি আমার অতীতকালের কোনো সাক্ষী কিংবা কোনো নিশানার ঢাকনা উন্মোচন করতে চেয়েছি—সেদিন আরও যোগ করেছিল: ‘মাই ডিয়ার গাই রোঁল্যা, আজ থেকে আর পেছন দিকে তাকিয়ো না; শুধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়েই ভেবো। আমার সঙ্গে কাজ করবে নাকি?...’ আমার জন্য যদি সে কোনো টান বোধ করে থাকে, তাহলে তা এ কারণেই যে (ব্যাপারটা আমি পরে জেনেছি) সেও তার নিজেকে নিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল, তারও জীবনের একটা পুরো অধ্যায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল অন্ধকারে—অতীতের সঙ্গে তখনো তার নিজের যোগ ঘটানো যায় এমন সামান্য কোনো নিশানা, সামান্য কোনো সংযোগসূত্র না রেখে। কারণ, এই ক্লান্ত বুড়ো মানুষটা, যাকে আমি তখন দেখছি গায়ে জীর্ণ এক কোট চাপিয়ে আর কালো রঙের বড় এক ফোলিও হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে চলে যাচ্ছে, সেই বৃদ্ধ আর অতীত দিনের সুদর্শন এক টেনিস খেলোয়াড়, হালকা-হলুদ চুলের বাল্টিক ব্যারন কনস্টান্টিন ফন হুট্টের মধ্যে কি মিল আছে কোনো?
পাত্রিক মোদিয়ানোর মিসিং পারসন উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের অনুবাদ।

No comments

Powered by Blogger.