তিনি কী বলেন আর কী করেন by সিরাজুর রহমান

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সকল পক্ষী মৎসভক্ষী, শুধু মৎসরাঙ্গা কলঙ্কিনী/সবাই কলম চেয়েই লেখেন, আমিই শুধু কলম কিনি।’ বাংলাদেশে বহু ওয়াকিবহাল সূত্র বলেছে ও লিখেছে, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাননি; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বেছে বেছে মাত্র কয়েকজনের বিরুদ্ধে সরকারের ও শাসক দলের আক্রোশ নেমে আসে। এদের মধ্যে সর্বশেষ হচ্ছেন গত বছরের শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পরিকল্পনামন্ত্রী এবং মাত্র কয়েক দিন আগে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ফোরামের প্রধান এয়ার মার্শাল এ কে খন্দকার। একাত্তরের মার্চ মাসে কয়েক দিনের ব্যর্থ আলোচনার শেষে ২৫ তারিখে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে পাকিস্তানে একটা ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব তার একান্ত সচিব জমির উদ্দিন আহমেদকে (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রদূত) বিকেল ৪টায় তার প্রস্তাবের জবাব পাওয়ার আশায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পাঠিয়েছিলেন। ভুট্টোর প্রবক্তা গোলাম মোস্তাফা খার জমির উদ্দিনকে সন্ধ্যা ৮টায় আবার আসতে বলেন, কেননা ভুট্টো তখন নাকি ঘুমুচ্ছিলেন। জমির উদ্দিন ৮টার সময় গিয়ে জানতে পারেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে চলে গেছেন। ফিরে এসে সে খবর দিলে মুজিব কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন। পরে জমির উদ্দিনকে আবার পাঠালেন ভুট্টোর জবাব শুনে আসতে। এবারে গোলাম মোস্তাফা খার জমির উদ্দিনকে পরিষ্কার বলে দিলেন যে, ভুট্টো তার সাথে দেখা করতে চান না। শেখ মুজিবের বাড়িতে ফিরে গিয়ে জমির সে খবর দিলে মুজিব জমিরকে ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে বলেন। তিনি বলেন, ‘জানি রে, এরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।’ জমির তার গায়ে হাত দিতে মুজিব বলেন, ‘আমি তাজউদ্দীনদেরকে বলেছি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি কী করি বল্্, আমি কী করি বল্।’ জমির উদ্দিনের সাথে আমার সাক্ষাৎকারটি ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতার পনের বছর’ নামে বিবিসি থেকে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানমালায় প্রচারিত হয়েছিল। সে বছরই ঢাকার ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড একই নামে সেসব অনুষ্ঠানের অনুলিপি পুস্তকাকারে প্রকাশ করে।

স্বেচ্ছা বন্দিত্ব এবং নির্বাচিত আক্রোশ
গোটা সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বোঝ যায় শেখ মুজিবুর রহমান সে রাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। কিছুকাল আগে প্রকাশিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা’ নামের বইতে মুক্তিযুদ্ধকালীন নির্বাসিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ সবিস্তারে মুজিবের সাথে সে সন্ধ্যায় তাজউদ্দীনের সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছেন। তাজউদ্দীনের অনুরোধেও মুজিব লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণাটি রেকর্ড করতে অস্বীকার করেন। বিগত কয়েক বছরে আরো অনেকে লিখেছেন এ দাবি সত্যি নয় যে মুজিবই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অনেকেই পরিষ্কার বলেছেন, স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান; কিন্তু মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা (মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রথম সন্তান প্রত্যাশা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন) কিছুতেই তেমন কথা সহ্য করতে রাজি নন। সম্ভবত এ কারণে যে তা হলে স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর শেখ পরিবারের একক বংশানুক্রমিক দাবি নাকচ হয়ে যায়।
কিছু দিন আগে মুক্তিযুদ্ধের উপ-মহাঅধিনায়ক এয়ার মার্শাল এ কে খন্দকার তার স্মৃতিকথা প্রকাশ করে মহা বিপদে পড়েছেন। তার বইয়েরও একটা মোক্ষম কথা, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। ব্রিটেনের বিগত লেবার দলীয় সরকার নিষিদ্ধ করার আগে পর্যন্ত ইংরেজ বিত্তশালীদের একটা গ্রীষ্মকালীন প্রমোদ ছিল দল বেঁধে আর ঘোড়ায় চড়ে ফক্স হান্টিং করা। প্রত্যেকটি শিকারি দলের একপাল হাউন্ড (শিকারি কুকুর) থাকত। হান্টের নেতা ভেঁপু বাজালেই কুকুরের পাল শেয়ালকে তাড়া করে ধরত এবং ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত। আওয়ামী লীগের দিক থেকে শেখ হাসিনার সর্বশেষ বৈধ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের ওপর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহলের প্রায়ই পুনরুক্তির অযোগ্য গালিগালাজ দৃষ্টে আমার সে কথা মনে হয়েছে। এসব গালিগালাজের ফলে এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ফোরামের চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিয়েছেন। তার স্থলে নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন জেনারেল সফিউল্লাহ। দেখা যাচ্ছে যে, সর্ষের মধ্যেও ভূত থাকে। আপনাদের যাদের মনে নেই তাদের অবগতির জন্য বলছি, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতে মুজিব সেনাবাহিনীর প্রধান এই জেনারেলের কাছে সাহায্য চাইলে তিনি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এবং বলা প্রয়োজন যে, জেনারেল সফিউল্লাহও বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। এ কে খন্দকার নতুন কী কথা বললেন, বিশেষ করে কেন তিনি আওয়ামীদের এমন হিংস্র্র আক্রমণের শিকার হলেন বুঝতে পারি না।

সুন্দরবন আর বাঘ নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ
অবশ্যি আওয়ামী লীগ নেতাদের কাজকর্ম আর উক্তির মধ্যে যুক্তিতর্ক ও কার্যকারণ খুঁজতে যাওয়া অরণ্যে রোদনের শামিল হবে। এদের মধ্যে দলের নেত্রীকে সর্বোচ্চে স্থান দিতেই হবে। তার কথা ও কাজে পরস্পর-বিরোধিতা ক্রমেই বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিদেশে গেলে প্রগলভতা বেড়ে যায় বলেই প্রধানমন্ত্রীর উক্তির হাস্যকর পরস্পর বিরোধিতা আরো বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। অরো লক্ষ করার বিষয় কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তৃতা করার সুযোগ পেলে তিনি মনে করেন মানব জাতিকে উপদেশ খয়রাত করার একটা জন্মগত অধিকার তার আছে। তিনি ভুলে যান যে, ইন্টারনেট আর সামাজিক মিডিয়ার যুগে তার নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও খুঁতগুলো কারোর অজানা নয়। অযাচিত জ্ঞান ও উপদেশ বিতরণ বিদেশীরা শুনতে বাধ্য হন কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রাখার খাতিরে। ভেতরে ভেতরে কিন্তু তারা হেসে কুটিপাটি হন।
 জাতিসঙ্ঘে পরিবেশ দূষণমুক্ত করা ও রাখা সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা বলেছেন, পরিবেশের দূষণ উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশ কম হচ্ছে। তিনি কি মনে করেন যে, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক বিতর্কের খবর বিদেশীরা রাখেন না? কয়লা নিঃসৃত কার্বন মনোক্সাইড বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের একটা প্রধান কারণ বলে স্বীকৃত। এ কারণে বহু উন্নত দেশ এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা জ্বালানো ছেড়ে দিয়েছে। বিকল্প হিসেবে তারা সৌর ও বায়ুশক্তি, সমুদ্রের ঢেউকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছে। বিগত কয়েক দশকে কয়লার বিদূষণে চীন ছিল সবচেয়ে বড় অপরাধী। সে চীনও এখন কয়লার ব্যবহার থেকে সরে আসছে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার সারা বিশ্বের আগ্রহের বস্তু। বাংলাদেশের নাম যারা জানে না তারাও রয়েল বেঙ্গল টাইগার পছন্দ করে। রামপালের প্রকল্পটি সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অবলুপ্তি ঘটাবে, এ আশঙ্কায় বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন। তার পরেও এ সরকার কক্সবাজারের মহেশখালীতে আরো একটি কয়লা জ্বালানো বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। শেখ হাসিনার কথায় দেশে ও বিদেশে কেউ আশ্বস্ত হতে পারছে না। তিনি যখন পরিবেশ বিষয়ে উপদেশ ভিক্ষা দেন বিশ্ববাসী তখন কি হাসবে না কাঁদবে?

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা ধসে পড়ছে
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের আহূত ‘শিক্ষাক্ষেত্রে বৈশ্বিক উদ্যোগ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বাংলাদেশের স্বনির্মিত প্রধানমন্ত্রী সমরাস্ত্রের পরিবর্তে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বের দেশগুলোকে। আমরা আশ্চর্য হয়ে ভাবছি, এই কি সেই তিনি যিনি কিছুকাল আগে মস্কোতে গিয়ে ঋণ করে বহু হাজার কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র কিনে এসেছিলেন? এ কথা তিনি বিবেচনায় আনেননি যে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের রাশিয়া শুধু অস্ত্রের জোরে চেচনিয়া আর দাগেস্তান নামে দুটো মুসলিম দেশকে পদাবনত করে রাখছেন, ২০০৯ সালে জর্জিয়া রাজ্যটি আক্রমণ করে সে দেশের সাউথ ওসেটিয়া নামের এলাকা দখল করে নিয়েছেন, চলতি বছরেই ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া উপদ্বীপটি ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং রুশ সৈন্য পাঠিয়ে পূর্ব ইউক্রেনের কয়েকটি এলাকা বিচ্ছিন্ন করে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে চরম স্বৈরতন্ত্র বেলারুশে গিয়ে সে দেশ থেকেও কর্জ করে সমরাস্ত্র ক্রয় করেছেন তিনি।
বাংলাদেশে শিক্ষা, বিশেষ করে নারীশিক্ষার উন্নয়ন করে আকাশে তুলেছেন বলে শেখ হাসিনা গর্ব করেন। বিদেশে এই বলে তার গর্বের সীমা নেই; কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ কী দেখছে? প্রকৃত পরিস্থিতি এই যে, নর-নারী সবার জন্যই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধসে পড়েছে। নামে তিনি একের পর এক বিশ্বদ্যিালয় গড়ে তুলছেন; কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয় বিগত ছয় বছরে বেসামাল ব্যাংক গঠনের মতোই রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্ত মাত্র। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ও গঠনের অনুমতি দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের শোষকদের। শিক্ষা সম্পর্কে যাদের সামান্যতম ধারণাও আছে তারাই জানেন যে উচ্চশিক্ষায়, বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষায় বহু ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। চিকিৎসা শিক্ষায় আরো বেশি এবং আরো মহামূল্য যন্ত্রপাতি অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে এসব রাজনৈতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টি এসব যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সংগ্রহ করেছে দেখেছেন কেউ? শুনেছি তারা সার্টিফিকেট বিক্রি করে টাকা কামাই করে। আওয়ামী লীগ নেত্রীর আদরের দুলাল ছাত্রলীগ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিবাণিজ্য করে ফুলে উঠছে। তারা টাকার বিনিময়ে ভর্তিতে, পরীক্ষায় নকলে সাহায্য করে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিক্রি করে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও সেসব দুর্নীতিতে শরিক হতে হয়, কেননা বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য কিংবা পূর্ণক্ষণিক শিক্ষক নেই, অথচ একটা সার্টিফিকেট না হলে চলে না।
স্কুলের শিক্ষার অবস্থাও তথৈবচ। বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্পে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। তা সত্ত্বেও সরকার পাঠ্যপুস্তক ছাপাচ্ছে ভারতে। যথাসময়ে পাঠ্যবই আসছে না। কখনো কখনো পাঠ্যবই পেতে বছরের অর্ধেক গড়িয়ে যায়। বহু স্কুলেই যোগ্য শিক্ষক নেই। যারা আছেন তাদের আওয়ামী লীগের টাউটগিরিতে ব্যস্ত থাকতে হয়। দেশে মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের কোনো জনসমর্থন নেই; কিন্তু মিডিয়াকে জনসমর্থন দেখানোর আশায় স্কুলের শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের পক্ষে স্লেøাগান দিতে বাধ্য করা হয়। পড়াশোনায় শিশুদের মন উঠে যাচ্ছে বলে কেউ কেউ আমাকে বলেছেন।
 আর নারীশিক্ষা? ইন্টারনেটে প্রায়ই পড়ি ছাত্রী হলে রাতের বেলা ছাত্রলীগের লোকেরা আনাগোনা করছে, ছাত্রলীগ নেতাদের হলের কামরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের পাওয়া যাচ্ছে এবং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হুকুম মেনে না চললে ছাত্রীদের ওপর রীতিমতো দৈহিক নির্যাতনও হয়। গত পৌনে ছয় বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন ছাত্রীর ওপর শিক্ষকদের যৌন নির্যাতনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আছে; কিন্তু এসব শিক্ষকের কারো বিরুদ্ধেই চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিচিত্র নয় যে, বহু অভিভাবক কম বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিতে চান এবং সে জন্য সরকারকে বিয়ের বয়স কমিয়ে শিশু বিয়ের আইন করতে হয়। ছাত্রলীগ এবং শিক্ষকদের দ্বারা নির্যাতিত হতে ভবিষ্যতে কতজন বাবা-মা মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে চাইবেন? রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর উচ্চশিক্ষার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার অধীনে বিএনপি সরকার সে উদ্যোগকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছে। আমার মনে হয় বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে নারীশিক্ষাকে অনেক দূর পেছনে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর বৃহত্তম লটবহর
বিদেশ সফরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী যাকে পান তাকেই বাংলাদেশে লগ্নি করতে এবং বাংলাদেশকে সাহায্য দিতে অনুরোধ করেন। বাহ্যত তিনি তাদের বলতে চান যে, বাংলাদেশের উন্নতি আর প্রবৃদ্ধির চিন্তায় রাতে তার ঘুম হয় না। তিনি ভুলে যান যে, বিদেশীদেরও চোখ-কান আছে। তিনি যে ১৮৫ জন সফরসঙ্গী নিয়ে নিউ ইয়র্কে এসেছেন এবং নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে দামি হোটেলগুলোর একটিতে তাদের পোষণ করেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের দ্বারা প্রতারক বলে ঘোষিত একজন সচিবও আছেন শেখ হাসিনার সফরসঙ্গীদের মধ্যেÑ এসব খবর জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি দলগুলোর কার না অজানা আছে? এটাও তারা বোঝে যে, দরিদ্র দেশটির অর্থে (খুব সম্ভবত ঋণলব্ধ) সম্পূর্ণ বিনাপ্রয়োজনে দলীয় চাটাদের এবং আত্মীয়স্বজনদের প্রমোদ ভ্রমণে নিয়ে আসা এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল নিউ ইয়র্কে বিশাল দলবল নিয়ে জন্মদিন উদযাপন করা রীতিমতো দুর্নীতি, কেননা স্বজনপ্রীতি, আত্মীয় তোষণ ইত্যাদি সব সভ্য দেশেই দুর্নীতি বলে বিবেচিত।
আর কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী এমন বিশাল দলবল নিয়ে জাতিসঙ্ঘে আসেননি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এসেছেন ১৪ জন সফরসঙ্গী নিয়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী নিরাপত্তা রক্ষীসহ ৬৯ জন। ৮৫ জন সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী নিজেদের ব্যয়ে এবং স্বতন্ত্রভাবে নিউ ইয়র্কে এসেছেন এবং বাংলাদেশের আর বিদেশের বিশেষজ্ঞরা একমত যে দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি আর ভ্রান্ত কূটনীতির কারণেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে এবং বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসাতেও খরা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় যার তার কাছে সাহায্য ও বিনিয়োগ চাওয়া হাস্যকর মনে হবে না কি?
আপনারাও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, বিশিষ্ট কোনো লোকের ফটো কিংবা টেলিভিশন ছবি তোলার সময় পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভিড় করে সে ছবিতে মুখ দেখাতে চায়। অনেকেই আমাকে বলেছেন সভা সমিতি কিংবা অনুষ্ঠানে বিদেশী কোনো রাষ্ট্রনায়ক উপস্থিত থাকলে ভিড় ঠেলেও বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীরা সেখানে যাবেনই। প্রচারবিদেরা সেটাকেই বিরাট অর্জন বলে দেখানোর কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখেন না। এবারে জাতিসঙ্ঘে আগত ১৫০ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সম্মানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নৈশভোজ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পুত্র জয়কে নিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। একজন পরিচিত লোকও সামনে এসে দাঁড়ালে জিজ্ঞেস করতে হয় ‘কেমন আছেন’? তিনি যদি বলেন, এটা আমার ছেলে, তখন বলতেই হয়, বাহ্্ বেশ সুন্দর ছেলে। এ হচ্ছে নিছক সৌজন্য। এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা সুরুচির পরিচায়ক কি?
গত জুলাই মাসে নারীশিশুবিষয়ক একটা আলোচনা সভায় যোগ দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেত্রী লন্ডনে এসেছিলেন আবারো রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে বিরাট দলবল নিয়ে। তার সৌজন্য সাক্ষাতের অনুরোধ ভদ্রতার খাতিরেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এড়াতে পারেন না; কিন্তু তার পরে যে কাণ্ড হলো সেটা রীতিমতো ন্যক্কারজনক। এ জাতীয় বৈঠক সম্পূর্ণ গোপনীয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সে সস্পর্কে কিছুই বলা হয় না; কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সাথে সংশ্লিষ্টরা মিডিয়াকে খবর দিলেন যে, ডেভিড ক্যামেরন বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলেননি, অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার প্রকারান্তরে সে নির্বাচনী তামাশাকে স্বীকৃতিই দিলো। প্রধানমন্ত্রীর দফতর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট তাদের রীতিনীতি ভঙ্গ করে বিবৃতি দিতে বাধ্য হলো। সে বিবৃতিতে বলা হয় যে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মোটেও ৫ জানুয়ারির তামাশাকে নির্বাচন বলে স্বীকৃতি দেননি। বরং তিনি আলোচনার মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন করারই তাগিদ দিয়েছেন। এর পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও ব্রিটিশ জাতির কাছে বাংলাদেশের মানমর্যাদা বাড়ল কি?

জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বাণী সেন্সর
শেখ হাসিনার এবারের জাতিসঙ্ঘ সফরের একটা বিশেষ তাৎপর্য ছিল। ৪০ বছর আগে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে। সে উপলক্ষে মহাসচিব বান কি মুন একটা বিশেষ বাণী পাঠিয়েছিলেন। সরকার নিজেদের পিঠ চাপড়ানোর আশায় সে বাণী মিডিয়ায় প্রকাশ করে; কিন্তু প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই ফাঁস হয়ে যায় মহাসচিব যেখানে অবাধ ও সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার তাগিদ দিয়েছেন তার বিবৃতির সে অংশ সরকার মিডিয়াকে দেয়নি। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বোধ করি ভুলে গিয়েছিল যে, বান কি মুন সারা জীবন কূটনীতি করেছেন, ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ার পাত্র তিনি নন। তার সাথে এবারে শেখ হাসিনার সাক্ষাতের ওপর যে বিবৃতি মহাসচিবের দফতর প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে : বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনাকালে বান কি মুন ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন’।
সরকার এখন বাংলাদেশের মিডিয়াকে পুরোপুরি হাতের মুঠোয় রাখতে সচেষ্ট। দেশের মানুষকে এখন অনেক সত্য জানতে দেয়া হয় না। সরকার যা প্রচার করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো তথ্যনির্ভর নয়। অর্থাৎ দেশের মানুষ অনেক কিছুই জানে না; কিন্তু আমরা যারা প্রবাসে আছি অনেক কিছুই আমরা জানতে ও শুনতে পাই এবং শুনে লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা যায়। বহু প্রবাসী বাংলাদেশীকে বলতে শুনেছি, নেতা-নেত্রীরা যদি বিদেশ সফরে না যেতেন এবং বক্তৃতা-বিবৃতি একটু কম করতেন তাহলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা আরো উজ্জ্বল থাকত।
 (লন্ডন, ৩০.০৯.১৪)
serajurrahman34@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.