ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে কায়েমি স্বার্থবাদীদের থাবা by সাজ্জাদুল ইসলাম

ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০ অক্টোবর একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অপর একজন নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে যাচ্ছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সুশিলো বামবাং ইয়দোয়োনো নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জকো উইদোদোর কাছে এ দিন ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। বর্তমান সময় পর্যন্ত একটি ছোট্ট গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার উচ্চপর্যায়ের রাজনীতি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এদের রাজনৈতিক আনুগত্যের পরিবর্তন ঘটলেও এরা প্রায় সব ক্ষেত্রে পারস্পারিক স্বার্থের বাঁধনে আবদ্ধ। অবশ্য নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এ চক্রের বাইরে থেকে এসেছেন। এরই মধ্যে পুরনো নেতারা পরবর্তী প্রেসিডেন্টের উচ্চাভিলাষী সংস্কার পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করেছেন।

>> বর্তমান প্রেসিডেন্ট সুশিলো বামবাং ইয়দোয়োনো এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জকো উইদোদো
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জকোভি নামে সুপরিচিত। তার বাবা ছিলেন একজন কাঠুরিয়া। জাভার মধ্যাঞ্চলের মাঝারি ধরনের শহর সোলোতে নদীর তীরের চালাঘরের বাড়িতে বড় হন তিনি। ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও বাইরে ভোটারদের সাথে দেখা করার সময় উইদোদোকে অত্যন্ত প্রাণবন্তু দেখায়। তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন, বক্তৃতা দেয়ার জন্য যাত্রাবিরতি করেন এবং এ ক্ষেত্রে জাঁকজমক প্রদর্শনকে ঘৃণা করেন। জকোভি ইন্দোনেশিয়ার নতুন ধরনের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন: তিনি বয়সে তরুণ, বাস্তববাদী ও গতিশীল; তার কাছে সহজে যাওয়া যায় এবং কোনো ধরনের দুর্নীতি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তরুণসমাজ, প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন ভোটারদের সমর্থনে তার রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছে। দলীয় নেতৃত্বের সিঁড়ি বেয়ে নয়, বরং শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও সুশাসনের সুকীর্তির মাধ্যমে তার উত্থান ঘটেছে। সোলোর মেয়র ও পরে জাকার্তার গভর্নর হিসেবে তিনি সেখানকার যানজট,বন্যা ও পয়ঃনিষ্কাশনের মতো নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যাসহ জনগণের সমস্যা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জনগণ তার এসব কাজ প্রত্যক্ষ করেছে। অন্য রাজনীতিকেরা অবশ্য জনগণের এসব দুর্ভোগ নিরসনে তেমন একটা সময় দেন না।
ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালে জকোভি একজন মহান নেতা হিসেবে দেশটির ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ইয়দোয়োনোর এক দশকের শাসনামলে ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাপক অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছে। কয়লা, তেল, গ্যাস ও কাঠের চাহিদা পূরণের জন্য চীন ইন্দোনেশিয়ার ওপর নির্ভর করার কারণে অংশত এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে। ২০১০-২০১২ অর্থবছরে যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৩ শতাংশ সেখানে চলতি বছরের প্রথমার্ধে তা নেমে এসেছে ৫.২ শতাংশে।
এ ছাড়া আগামী ছয় বছরে ইন্দোনেশিয়ার শ্রমশক্তির সাথে যোগ হবে আরো দেড় কোটি মানুষ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, তারা মনে করেন, ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। আর এ জন্য দেশটিকে তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যে তেল আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। দেশটির জ্বালানি ভর্তুকি কমানো অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জন্য সরকারের বাজেটের এক-পঞ্চমাংশ ব্যয় করতে হয়। জকোভি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ত্যাগের আগেই জ্বালানি ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক সমালোচনার ঝুঁকি গ্রহণের জন্য ইয়দোয়োনোকে সম্মত করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও পিডিআইপি পার্টির নেতা মেঘবতী সুকর্নপুত্রীর সম্পর্ক ভালো নয়। জকোভি পিডিআইপি পার্টির সদস্য। আর সে কারণে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট তার কথায় সম্মত হননি।
জকোভি বুঝতে পারছেন, তার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের শুরুর দিকে জ্বালানি ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ পদক্ষেপ গ্রহণ যেকোনো নেতার জন্যই বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু জকোভি আরো খারাপ কিছু হতে পারে বলে মনে করছেন। নির্বাচনে তিনি যাকে পরাজিত করেছেন, তিনি হলেন সাবেক বিশেষ বাহিনীর জেনারেল প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তো। তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি হলেন পুরনো নেতাদের চক্রের সদস্য। সুহার্তো আমলের লোকদের সাথে তার সম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে। তিনি জকোভির বিরুদ্ধে লড়তে সঙ্কল্পবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে ৫০০টি প্রাদেশিক গভর্নর, রিজেন্সি প্রধান ও সিটি মেয়র পদে সরাসরি নির্বাচন বাতিল বিল অনুমোদনের ঘটনায় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয় প্রকাশ পায়। পার্লামেন্টের বেশির ভাগ সদস্য প্রাবোয়োর ‘রেড-হোয়াইট’ জোটের অন্তর্ভুক্ত। এর ফলে আঞ্চলিক পরিষদ এসব স্থানীয় সরকারপ্রধান নিয়োগ করবে। আঞ্চলিক পরিষদগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে রেড-হোয়াইট জোট। জকোভি ছিলেন সাবেক মেয়র ও গভর্নর এবং সরাসরি ভোটের ফসল হিসেবে তার উত্থান ঘটেছে, এ বিষয়টি কারোরই চোখ এড়ায়নি।

No comments

Powered by Blogger.