মধ্যপ্রাচ্যে উগ্রবাদের উত্থান ও আমরা by এম সাখাওয়াত হোসেন

মধ্যপ্রাচ্যে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার নাম ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ইরাক ও সিরিয়ার মরুপ্রান্তরের বালুঝড় এখন আচ্ছন্ন করছে উত্তর আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে এই ঝড়ের বাইরে থাকতে পারছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জনা চারেক তরুণকে আইএসে যোগদানের জন্য ইরাক-সিরিয়া অভিমুখে যাত্রার প্রস্তুতির অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। অবশ্য গ্রেপ্তারের আওতায় অন্তর্ভুক্ত দু-একজনকে নিয়ে কিছু বিতর্কও দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে সামিউন রহমান ওরফে ইবনে হামদান নামের একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ ব্রিটিশ নাগরিককেও আটক করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি ছয় মাস ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধরত আইএসের হয়ে নতুন যোদ্ধাদের খোঁজে। তিনি তাঁর অবস্থানকালে কতজনকে পাঠিয়েছেন, সে তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

সামিউন ওরফে ইবনে হামদান সম্পর্কে যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে প্রতীয়মান যে তিনি ইতিমধ্যে সিরিয়ার রণক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশ, যেখানে তথাকথিত জিহাদি সংগ্রাম চলছে, ভ্রমণ করে বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি ব্রিটেনে কারাভোগও করেছিলেন অবশ্য ভিন্ন কারণে। তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। তবে জানা যায়নি যে তিনি দ্বৈত নাগরিক কি না। তিনি এত দিন বাংলাদেশে কীভাবে অগোচরে ছিলেন? তিনি কীভাবে কোন পথে এ দেশে প্রবেশ করেছেন? এসব তথ্য প্রকাশ না করলে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে সব তথ্য লুকানোর একটা বড় প্রবণতা রয়েছে। কাজেই পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে এ ধরনের আলোচনাও অসম্পন্ন থাকে।
সামিউন ওরফে হামদান একজন তরুণ এবং পশ্চিমের উদার সমাজ ও গণতন্ত্রের আবহাওয়ায় লালিত-পালিত। তাঁর মতো তরুণেরা সেক্যুলার সমাজ ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে বড় হলেও কী কারণে এ ধরনের সংগঠনের ডাকে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হন, তা এখনো গবেষণার বিষয়। খবরে প্রকাশ, ব্রিটেন থেকেই প্রায় চার শ তরুণ যোদ্ধা এখন আইএসের হয়ে তথাকথিত জিহাদ ও অন্যান্য গর্হিত কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ইরাক অঞ্চলে যে তিনটি শিরশ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও এক ব্রিটিশ তরুণ নাগরিকের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করেছে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে চার হাজারের বেশি যোদ্ধা গেছেন সিরিয়া ও ইরাকে। এর মধ্যে ১৫০ জন অস্ট্রেলিয়ার ও ৫০ জন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রয়েছেন বলে ওই সব দেশের সংশ্লিষ্ট লোকজন নিশ্চিত করেছেন। আরও যুক্ত হয়েছেন কয়েক শ ইন্দোনেশীয় যুবক। ধারণা করা যায় যে অন্যান্য দেশের নাগরিকেরাও ঘোষিত খেলাফতের পতাকাতলে জমায়েত আছেন এবং হওয়ার পথে রয়েছেন। বাংলাদেশ যে এর বাইরে নেই, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে কয়েকজন নাগরিককে সন্দেহবশত গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের সবাই হামদানের প্রজন্মের এবং একই প্রেক্ষাপটের। খবরে প্রকাশ, এঁরা কোনো মাদ্রাসার ছাত্র বা সমাজের নিম্ন আয়ের মধ্য থেকে আসেননি। এঁদের সবাই বাংলাদেশের সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের। কাজেই প্রশ্ন উঠছে যে কেন এমন ধরনের তরুণেরা এ ধরনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়িয়েছেন। কারা কী পন্থায় এঁদের বিপথগামী হতে উদ্বুদ্ধ করছে। এর উত্তর সহজলভ্য নয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচলিত নিয়মে যেভাবে তথ্য আহরণ করা হয়, তা মোটেও বৈজ্ঞানিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের আওতায় নয়। অত্যন্ত সরলীকৃত জবাব ও তথ্য প্রকাশ করা হয়, সে কারণে প্রেক্ষাপটের গভীরে প্রবেশ করা সম্ভব হয় না। তথ্য নেই যে এ ধরনের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনে যুক্ত হওয়ার মনস্তাত্ত্বিক কারণ কী হতে পারে! হতে পারে পারিবারিক, সামাজিক অথবা বিভিন্ন বিষাদগ্রস্ত হওয়ার কারণে এসব পথ বেছে নেয়।
ইরাক ও সিরিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি আশির দশকের আফগান পরিস্থিতি থেকে কিছুটা ভিন্নতর হলে এর সূতিকাগৃহ প্রায় অভিন্ন। দুই প্রেক্ষাপটের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য থাকলেও ধরনের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। আফগান জিহাদ ও আইএস খেলাফতের সঙ্গে একই কায়দায় তরুণেরা আকৃষ্ট হলেও বৈসাদৃশ্যও লক্ষণীয়। একুশ শতকের ধর্মীয় উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসের সঙ্গে প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাসকে ভ্রান্ত প্রমাণ করছে। একুশ শতকের জিহাদিরা বিশ শতকের জিহাদিদের মতো শুধু তথাকথিত মাদ্রাসাশিক্ষিত নন। আফগান জিহাদি বা তালেবানদের মতো নিম্নবর্গের তরুণ নন। এখনকার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা তরুণ ও শিক্ষিত। আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তঁাদের রয়েছে প্রযুক্তির জ্ঞান। বাংলাদেশে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের বয়স, চিন্তাভাবনা ও একাগ্রতা লক্ষণীয়। এ কারণেই আমি মনে করি, এঁদের গ্রেপ্তার করে শুধু ‘রিমান্ডে’ নিলেই সমস্যাটির গভীরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের, যাতে ভবিষ্যতের করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়। বিষয়টি আমরা যত সরলভাবে দেখি, তা তত সরল বা সহজ নয়।
ইরাক ও সিরিয়ার কিছু অংশে ‘খেলাফত’ কায়েম হয়েছে। যত বিতর্কিতই হোক, এটাই এখন বাস্তবতা। এই খেলাফতের গোড়াপত্তন হয়েছে সুন্নি-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। সিরিয়া ও লিবিয়ার আরব বসন্তের হোতারা হয়তো ধারণা করতে পারেননি যে বসন্ত এত ক্ষণস্থায়ী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে স্বীকার করতে হয়েছে যে তাঁর গোয়েন্দারা অনুধাবন করতে পারেনি যে ইসলামিক স্টেট ও তার সহযোগীদের এত দ্রুত উত্থান হতে পারে। গোয়েন্দারা আইএসের সামর্থ্যের অবমূল্যায়ন করেছে, তারা বিশ্লেষণ করতে পারেনি, কী কারণে মুসলিমপ্রধান দেশসহ পশ্চিমা দেশের মুসলিম তরুণেরা দলে দলে যোগদান করছেন ওই অঞ্চলের জিহাদে। এর উত্তর খুঁজতে হলে সিরিয়ার সমস্যার অন্তরালে যেতে হবে।
সিরিয়া ও লিবিয়ায় পরিকল্পিতভাবে আরব বসন্তের বীজ রোপিত হয় ২০১১ সালের মাঝামাঝি কায়রোতে। এর হোতা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ সামরিক কর্মকর্তা বর্তমানে শক্তিশালী সিনেটর ম্যাককেইন। আরব বসন্তে যোগ দেওয়ার জন্য রিক্রুট করা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের জিহাদিদের। ক্রমেই যুক্ত হয় আল-কায়েদা। জন্ম নেয় আল-নুসরাহসহ এক ডজন সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। জন্ম নেয় আইএস। ইরাকে সুন্নি অভিযানের মধ্য দিয়ে বিশ্বে পরিচিত হয় আইএস। এতে যোগ দিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি দেশগুলোর বহু সদস্য। এমন তথ্যও রয়েছে যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের জেল থেকে বের করা হয়েছিল লম্বা সময়ের জন্য জেলে থাকা কয়েদিদের, তাদের বাধ্য করা হয়েছিল ইরাকে আইএসে যোগ দিতে। আইএসকে দেওয়া হয়েছিল তেলসমৃদ্ধ দেশের অর্থ। এর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল ইরাককে তিন খণ্ডে খণ্ডিত করা। কিন্তু আইএস সেই গণ্ডি পার হয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে এগিয়েছে। তাই পশ্চিমা দেশগুলোর জোট এখন শঙ্কিত হয়ে আইএসের গতি রোধ করতে বিমান হামলা শুরু করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়া ও লিবিয়ায় আরব বসন্তে বিদেশি নাগরিকদের যোগ দিতে বাধা দেওয়া হয়নি বলে আল-নুসরাহ ও আইএসে এত বিদেশির সমাগম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যমতে, দুই বছরে আইএসের যোদ্ধাদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ দুই বছর আইএস নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব তেমন মাথা ঘামায়নি কেন?
মুসলিম বিশ্বের অর্ধেক মুসলমানের আবাসস্থল ভারতীয় উপমহাদেশ আইএসের প্রভাবের বাইরে থাকতে পারছে না। পাকিস্তান তো একধরনের উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেই। আর বাংলাদেশে রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘাত, স্তরে স্তরে দুর্নীতি, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, ইসলামি জঙ্গিদের গোপন তৎপরতা। আমরা নিশ্চিত নই ইতিমধ্যে এ দেশ থেকে কত যুবক পাড়ি দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে আমাদের বড় এক জনগোষ্ঠী। তাদের দোরগোড়ায় জিহাদের ক্ষেত্র, কাজেই প্রবাসী কতজন প্রভাবিত হয়েছেন, তা জানার সক্ষমতা আমাদের সংস্থাগুলোর নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, উগ্রপন্থীদের চরিত্র ও অবয়বে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে, এদের খুঁজে বের করা আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে। উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটিয়েও যখন তাদের নাগরিকদের সিরিয়া-ইরাকে পাড়ি দেওয়া ঠেকাতে পারছে না, তখন বাংলাদেশের মতো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিক থেকে দুর্বল দেশ তার তরুণ-যুবকদের ‘জিহাদে’ যোগদান কতখানি ঠেকাতে পারবে, তা একটা ভাবনার বিষয়। আমরা যেসব তথ্য পাই, তা হয়তো হিমশৈলের সামান্য অংশ মাত্র। বৃহদাংশ হয়তো এখনো দৃষ্টির অন্তরালেই রয়েছে।
বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ। ১৬ কোটি মানুষের প্রায় ৮০ ভাগ সুন্নি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। রয়েছে বিশালসংখ্যক শিক্ষিত বেকার যুবক। দেশের অভ্যন্তরে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভাজন। বিভাজন রয়েছে সমাজেও। মাঝেমধ্যেই ধর্ম নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যকে ঘিরে সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। মাত্র কয়েক দিন আগে প্রবাসে বসে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী যেভাবে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কটূক্তি করেছেন, তাতে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। এ ধরনের কটূক্তি কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে করা সম্ভব কি না, জানি না। তবে তিনি যে উত্তেজনা উসকে দিয়েছেন, তা এ দেশের উগ্রবাদ ঠেকাতে সহায়ক হবে না। এ ধরনের উত্তেজনার মধ্যেই লালিত হন সামিউর ওরফে হামদানের মতো উগ্রপন্থী যুবেকেরা। এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে যদি সমাজের নেতৃস্থানীয়রা সচেতন না হন, তবে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এসব মন্তব্য উগ্রপন্থীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার সমপর্যায়ে পড়ে।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি যেমন কখনো সুখকর হয়নি, তেমনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত উগ্রবাদীদের অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা উগ্রবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমন্বিত প্রচেষ্টা। কেন বাংলাদেশের তথাকথিত সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত ও বেড়ে ওঠা যুবকেরা উগ্রপন্থী পথ বেছে নিচ্ছে, এর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বিশেষ প্রয়োজন আছে। ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যাধিটির গভীরতার ওপর নির্ভর করে। সন্ত্রাস বা উগ্রবাদ নামক ক্যানসারের চিকিৎসা করতে হলে এর গোড়ায় যেতে হবে; অন্যথায় এর বিস্তার রোধ বলপ্রয়োগে সম্ভব নয়। বন্ধ করতে হবে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর। অনুধাবন করতে হবে যে আমরা এক বিস্ফোরণমুখী সমাজে বাস করছি। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব অস্থিরতায় পড়েছে, আমরা তার বাইরে নই।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.