জেনে-শুনে বিষ করেছি পান by সালাহউদ্দিন লাভলু

বিনোদন শব্দটা অত্যন্ত মধুর। বিশেষ করে টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের দর্শকেরা বিনোদিত হতে চান। তবে সাম্প্রতিককালের ‘ঈদের নাটক এবং দর্শকদের বিনোদন’ এই সরল অঙ্কটায় কেন যেন ফলাফল শূন্য থেকে যাচ্ছে। মাসুম রেজার একটা লেখায় পড়েছিলাম, আগে ছিল ঈদের নাটক, এখন ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে নাটকের ঈদ। এই কথাটার সত্যতা ও যথার্থতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
শুনতে পেলাম গত ঈদে নাকি সব মিলিয়ে প্রায় তিন শ নাটক প্রচার হয়েছে। এই তিন শ নাটকের জন্য কমপক্ষে তিন শ নাট্যকার, তিন শ নির্মাতা এবং তিন শ পূরণ দশ সমান সমান তিন হাজার অভিনয়শিল্পী মজুত আছেন। ব্যাপারটা খুশিরই বটে। আমাদের কমবেশি ২৪টা চ্যানেল আছে। সে হিসাবে ২৪টা ঈদের নাটক হলে মহাভারতের কী এমন অশুদ্ধি ঘটে। একটির জায়গায় না হয় তিনটিই করলাম। তিন দিন ধরে ঈদের আনন্দ করেন। সরকারি ছুটি থাকে তিন দিন। তাতেও তো ৭২টি নাটকের বেশি প্রয়োজন পড়ে না। তা না করে এক দিনেই বাহাত্তরটি নাটক (!) প্রচারের চেষ্টা চলছে। বিনোদনের ছড়াছড়ি।
ইদানীং শুটিং স্পটে একটা শব্দ খুব শুনছি। প্যানা। প্রথমে এর অর্থ অনুধাবন করতে পারিনি, পরে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ইহা একটি মনুষ্য সৃষ্ট পেইন বা ডিস্টারব্যান্স। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে প্যানা শব্দটির সময়োপযোগী কিছু নমুনা তুলে ধরছি:

প্যানা ১
ঈদ হবে ৬ অক্টোবর। জুলাই মাসেই সিদ্ধান্ত হয়ে আছে অমুক চ্যানেলে অমুক নাট্যকার লিখবেন এবং অমুক নির্মাতা নাটকটি নির্মাণ করবেন। দাবিটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রচার কর্তৃপক্ষের। এখন বোঝেন প্যানাটা। তিন মাস আগে থেকে জানার পরও নাট্যকার সাহেব ইলেভেন্থ আওয়ারেও নয় টুয়েলভথ আওয়ারে দেবেনপাণ্ডুলিপি। এবার পাণ্ডুলিপি নিয়ে নির্মাতা ছুটতে শুরু করলেন অভিনয়শিল্পীদের পেছনে।

প্যানা ২
আগেই উল্লেখ করেছি আমাদের মতো ছোট্ট একটা দেশে তিন হাজার অভিনয়শিল্পী মজুত আছেন। কিন্তু নাট্যকার সৃষ্ট চরিত্রের জন্য যে শিল্পীর প্রয়োজন তার সংখ্যা বাস্তবত একজন কি দুজন। যেহেতু সেই একজন বা দুজন শিল্পী তাঁদের বাণিজ্যিক চাহিদার কারণে দিন হাজিরায় সময় বিক্রি করে দিয়েছেন। শুরু হলো প্যানার ওপর প্যানা। প্রয়োজন তিন দিন, কিন্তু যেহেতু তিনি সময় বিক্রি করে দিয়েছেন, সেহেতু উনি মূল্যবান একটা দিন দিয়ে ধন্য করলেন। নির্মাতা হিসেবে আমি নিস্তার পেলাম কিন্তু...!

প্যানা ৩
শুটিংয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নির্মাতাকে যখন ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে ভাবার কথা, তখন কথিত অভিনয়শিল্পী সেটে এসে কী খাবেন না খাবেন তা নিয়ে তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। সবই হলো ঠিকঠাক, কিন্তু সকালের নাশতা ঢাকা পড়ে থাকে। কারণ সকাল নয়টার কল তিনি এলেন বেলা দুইটায়। গাড়ি থেকে নেমেই রাস্তার যানজট, দেশের যোগাযোগব্যবস্থার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন তাতে নির্মাতাসহ ইউনিটের সবাই চুপচাপ শ্রোতা বনে গেলেন।

প্যানা ৪
এখানে কিছু উপপ্যানা বর্ণিত হবে। উপপ্যানা ১: মোবাইল ফোনের যথেচ্ছ আগমন, নির্গমন এবং ছবি উত্তোলন। উপপ্যানা ২: ফেসবুকে চ্যাটিং, আপলোডিং, ডাউনলোডিং। উপপ্যানা ৩: প্রথম দৃশ্যটি কোনোমতে হলো কিন্তু দ্বিতীয় দৃশ্যটিতে দেখা গেল কথিত অভিনয়শিল্পী তাঁর প্রয়োজনীয় কস্টিউম আনেননি। কারণ তিনি পাণ্ডুলিপি পড়ার সময়ই নাকি পাননি। অথচ বিভিন্ন মিডিয়াতে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেন আমি বেছে বেছে নাটক করি! তো তুমি বাবা স্ক্রিপ্ট না পড়ে কীভাবে বেছে বেছে নাটক করো, আমি বুঝি না।

প্যানা ১০
মাঝের পাঁচটি প্যানা সুযোগ পেলে অন্য কোনো ঈদে বলব। প্যানা ১০-এরও কিছু উপপ্যানা আছে। উপপ্যানা ১: নাটকের প্রযোজক বাহাদুর তাঁর অর্থবল এবং জ্যাকজুক লাগিয়ে প্রচার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম ওয়ার্কঅর্ডার নিয়ে নেন। ওয়ার্কঅর্ডার অনুযায়ী উনি মালামাল সরবরাহের জন্য নির্মাতাদের মাঠে নামান। তিন দিনের মাথায় ওনার মাথায় বায়ু চড়ে যায় মালামাল ‘বুঝিয়া লইবার জন্যে’। নাটক ওনার কাছে কেবলই চল্লিশ মিনিটের একটা পণ্য। এ রকম গোটা দশেক পণ্য সাপ্লাই করতে পারলে ওনার সুখ হয়। ইদানীং শুনছি এর ভেতরে আরেক মহাঠিকাদারের আবির্ভাব ঘটেছে, যাদের বলা হচ্ছে এজেন্সি। বিষয়টা আমি খুব বেশি পরিষ্কার না। উপপ্যানা ২: নাটকের শরীরে সবচেয়ে বড় অপারেশনটা চালানো হয় প্রচার কর্তৃপক্ষের টেবিলে। একটা নাটককে তাঁরা তিন চার পাঁচ যত খুশি, তত খণ্ডে খণ্ডিত করে বিজ্ঞাপন বিরতির ব্যবস্থা করেন। এর ভেতরে সংবাদ বাবাজিও দুবার প্রচারিত হন। একটা নাটকের প্রচার শেষ হতে প্রায় আড়াই ঘণ্টাও লেগে যায়। এই যদি হয় অবস্থা তবে সে নাটক দিয়ে বিনোদন জোগাব কার? উপপ্যানা ৩: দর্শক উপাস্য দর্শক নারায়ণ। আমাদের এত এত প্যানা সহ্য করে নির্মিত নাটক শেষমেশ আপনাদের সামনে আসে। কিন্তু আপনাদের অনেকেই তখন পাশের দেশের নাটকগুলোতে দিদিগণের কুটনামি আর কোন দিদি কোন দাদার ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন বা কোন দাদা কোন বউদিকে সহ্য করতে পারছেন না বলে মদ্যপ হয়ে উঠছেন, এসব নিয়েই মেতে থাকেন।
ওপরের প্যানাতে বর্ণিত সব ক্ষেত্রেরই অন্য চিত্র আছে। নাট্যকারদের সময়মতো পাণ্ডুলিপি প্রেরণ, শিল্পীদের সময়মতো শুটিং স্পটে উপস্থিত হওয়া, চরিত্র অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করা, প্রযোজকদের শুধুই অর্থ লগ্নি নয় পাণ্ডুলিপি পড়া থেকে শুরু করে প্রযোজনার সকল স্তরেই নিজের অংশগ্রহণ রেখে সঠিক দায়িত্ব পালন করা, প্রচার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য বিরক্তহীনভাবে নাটক প্রচার করার প্রয়াস—এসবই মুদ্রার অন্য পিঠ। তা না হলে আমরা এখনো কাজ করছি কীভাবে?
এই লেখা পাঠান্তে অনেকেই মনে মনে বলছেন, প্যানা তো নির্মাতারাও কম দেন না লাভলু ভাই। এতই যদি প্যানা তবে নাটক বানানো ছেড়ে দিলেই পারেন। এর উত্তরে আমার তেমন কিছু বলার নেই, শুধু বলব আমি জেনে-শুনে বিষ করেছি পান, প্রাণেরও আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।

সালাহউদ্দিন লাভলু: অভিনেতা, নাট্যনির্মাতা।

No comments

Powered by Blogger.