তোতা পাখির শিক্ষা ও মান নির্ধারণী পরীক্ষা by ম তামিম

মান নির্ধারণী পরীক্ষার প্রথম প্রচলন হয় চীনে, যখন সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের কনফুশিয়াসের দর্শন ও কবিতার পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে হতো। পশ্চিমা দেশগুলো মূলত সক্রেটিসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন বিষয়ে রচনা লেখার মাধ্যমে সম্ভাব্য চাকরিজীবীদের মেধা যাচাই করত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শিল্পবিপ্লবের সময় যখন ব্যাপক হারে চাকরি সৃষ্টি হয়, তখন একসঙ্গে অনেক ছাত্রের মেধা যাচাইয়ে মান নির্ধারণী পরীক্ষা নেওয়া  হয়। ১৯০৫ সালে ফ্রান্সের মনোবিজ্ঞানী আলফ্রেড বিনে আইকিউ পরীক্ষার ধারণা তৈরি করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের আগেই মাননির্ধারক পরীক্ষার (Standardized Test) মাধ্যমে সৈনিকদের মানসিকতা এবং সম্ভাব্য অফিসার পদপ্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে এ ধরনের পরীক্ষার ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এখন বিশ্বের সব দেশে স্কুল-কলেজেও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এই  মাননির্ধারক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়।

আমেরিকায় স্কুলপর্যায়ে কোনো জাতীয় মাননির্ধারক পরীক্ষা নেই। অষ্টম শ্রেণি শেষে জুনিয়র হাই এবং বারো শ্রেণির পরে হাই স্কুল গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা ও মান বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষা গাইডলাইনের ভিত্তিতে স্কুলভিত্তিকই হয়ে থাকে। যে কারণে ১৯২৬ সালে কলেজ বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রথম স্যাট বা স্ট্যান্ডারাইজড অ্যাপটিটিউট টেস্ট চালু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে স্যাট পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মোটামুটি অপরিহার্য হয়ে যায়। এই পরীক্ষাটি মূলত ইংরেজি ভাষা ও অঙ্কের পারদর্শিতা যাচাই করে। ২০০৫ সালে এর সঙ্গে রচনা লেখা সংযুক্ত হয়েছে। এখন বিষয়ভিত্তিক স্যাট পরীক্ষাও হয় এবং অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই সেগুলো অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে গণ্য করে।
ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম মাননির্ধারক পরীক্ষা দিতে হয়, যেখানে মূলত ভাষা, বিজ্ঞান ও অঙ্কের দক্ষতা যাচাই করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো একটি শিশুর শেখার ও তার বয়সে মূলত ভাষা ও অঙ্কের দক্ষতা অর্জনের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা। একই সঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন স্কুলের কার্যক্রম তুলনা করা। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের উন্নতি সাধন ও সাফল্যের চাবিকাঠি ভাগ করে নেওয়াই এর উদ্দেশ্য। এই পরীক্ষা ফলাফলের ভিত্তিতে ছাত্রের দুর্বলতা ও সাফল্য যাচাই করে বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। তারপর ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া করাটা বাধ্যতামূলক। অনেকে যারা ট্রেড বা ভোকেশনাল লেখাপড়া করার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ও-লেভেল পরীক্ষা দিয়ে সেদিকে চলে যায় এবং মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহীরা এ-লেভেল পরীক্ষা দেয়। আমেরিকায় যেহেতু স্যাট–এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়, অনেকেই জুনিয়র হাই শেষ করে ট্রেডে চলে যায় আবার কেউ কেউ হাই স্কুল শেষ করে।

ছোট থেকে শিশুর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা একটি অত্যন্ত জটিল কাজ। শুধু একটি পরীক্ষার মাধ্যমে একটি শিশুর দক্ষতা/মেধা যাচাই করা তাদের প্রতি অবিচার। ইংল্যান্ডে অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষক এবং স্কুলপদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও তাদের দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষাপদ্ধতির ব্যাপক সমালোচনা হয়। বলা হয়, একটি শিশুর মুক্তচিন্তা এবং বহুমুখী জ্ঞানার্জনের আনন্দকে গলা টিপে পরীক্ষার মাধ্যমে তোতা পাখি বানানো হচ্ছে। যার জন্য ২০১৬ থেকে এতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন পদ্ধতিতে সারা বছরের ক্লাসের মূল্যায়ন ও শ্রেণিশিক্ষকের পর্যবেক্ষণকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, তারা আশির দশকের শুরু থেকেই প্রথম বর্ষের নতুন ছাত্রদের মধ্যে একটা ধীর পরিবর্তন লক্ষ করি তাদের পঠিত সিলেবাসের বাইরের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। ধীরে ধীরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে পাসের হার ও নম্বরপ্রাপ্তি যত বৃদ্ধি পেতে থাকল, এই সমস্যাটি ততই প্রকট হয়ে দেখা দিল। পুরোনো প্রশ্নের ধারা, সম্পূর্ণ সিলেবাস বাদ দিয়ে খণ্ডিত অংশ পড়া, স্কুল, কলেজ ও কোচিং সেন্টারগুলোর চামচে তুলে নম্বরপ্রাপ্তির ফরমুলা গলাধঃকরণ আস্তে আস্তে একটি সম্পূর্ণ জাতির মুক্তচিন্তা এবং প্রতিটি ছাত্রের স্বকীয়তা প্রায় মৃতের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সিলেবাসে ছিল না অথবা ওই অংশ বাদ দিয়ে পড়েছি, এ রকম উত্তর অহরহই শুনতে হয়। বিজ্ঞান বা সাহিত্য, অবজেক্টিভ বা সাবজেক্টিভ বা এ দুইয়ের সংমিশ্রণ একটি ছাত্র যেদিকেই এগিয়ে যাক না কেন, তার বিশ্লেষণক্ষমতা থাকতে হবে। সিলেবাসে সীমাবদ্ধ নম্বরপ্রাপ্তির দক্ষতা দিয়ে সেটা অর্জন করা যায় না। পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থা, অদক্ষ অপ্রতুল শিক্ষক এবং কোচিংয়ের মাধ্যমে চরম বাণিজ্যিকীকরণ যে সত্যিকারের বিশ্লেষণধর্মী সুশিক্ষিত উচ্চমাধ্যমিক সমপর্যায়ের ছাত্র তৈরি করতে পারছিল না, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছে। তবে এর সুফল এখন অবধি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি।
আগে প্রতিটি স্কুলের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা হতো। স্কুলের নিজস্ব নিয়মে কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী এতে অংশ নিতে পারত। মেধার স্বীকৃতি ছাড়া এই বৃত্তি আসলে খুব কার্যকরী কিছু ছিল না। কারণ, লেখাপড়া করার আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। হঠাৎ করেই সবাইকে এই বৃত্তি পরীক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পঞ্চম শ্রেণিতে পিএসসির প্রবর্তন করা হলো। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের স্কুল শিক্ষার বাণিজ্যিক অংশের জন্য নতুন বাণিজ্যের অবারিত দ্বার উন্মোচন হলো। শুরু হয়ে গেল অভিভাবকদের জুজুর ভয়ের ইঁদুরের দৌড়। শিশুর গল্পের বই পড়া, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, নাচ-গান, আনন্দ—সব বন্ধ হয়ে গেল। পিএসসির ফলাফল হয়ে উঠল সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি। সকাল থেকে স্কুল, বাড়ির কাজ, কোচিং, নোট বই, প্রশ্নপত্র জোগাড় ইত্যাদির মহা তোড়জোড়ে মারা গেল শিশুর জানার আনন্দ আর মুক্তচিন্তা বিকশিত হওয়ার সব পথ। শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠল জিপিএ–৫ প্রাপ্তি। মান নির্ণয়ের পরীক্ষার দুটো মূল উদ্দেশ্যের একটি হলো স্কুলের ফলাফল যাচাই। জিপিএ–৫-এর বিজয় অঙ্গুলি দেখানোর দৌড়ে পিছিয়ে পড়া স্কুলগুলো নানা অনিয়মে জড়িয়ে যাচ্ছে। মূল সমস্যার সমাধানে না গিয়ে শতভাগ পাস এবং উচ্চ গ্রেডপ্রাপ্তিতে সরকারি পরিতৃপ্তি ও বাহবা এসব পিছিয়ে পড়া স্কুলগুলোকে তাদের কাঠামোগত এবং গুণগত মান উন্নয়নে সহায়তা করছে না।

পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জেনেছিলাম যে আমেরিকার শিক্ষাপদ্ধতির আদলে অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি প্রবর্তনের পরে পিএসসি ও এসএসসি  উঠিয়ে দেওয়া হবে। এখন দেখা যাচ্ছে যে মাত্র ১২ বছরের স্কুলে লেখাপড়ার সময়ে ছাত্রদের পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি—এই চারটি মান নির্ধারক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এসব পরীক্ষার উচ্চতর ফলাফলের আত্মতৃপ্তির বাইরে দুর্বল স্কুলগুলোর মান উন্নয়ন এবং ছাত্রদের মেধা ও মননের বিকাশ সাধনে এই ফলাফলগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার কোনো পরিষ্কার দিকনির্দেশনা সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান নয়। দুই বছর অন্তর জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে কী মান নির্ণয় করা হচ্ছে বা উদ্দেশ্য সাধন হচ্ছে, তাও বোধগম্য নয়। সত্যিকারের সৃজনশীল, অনুসন্ধানী ও অর্থবহ শিক্ষার চেয়ে যখন পরীক্ষার ফলাফল বড় হয়ে যায়, তখন প্রকৃত শিক্ষার মৃত্যু হতে বাধ্য। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এবং অপ্রয়োজনীয় (অতিরিক্ত) মান নির্ধারণী পরীক্ষা ছাত্রদের শেখানো বুলি আওড়ানো তোতা পাখিতে পরিণত করছে।
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে নোট এবং শিক্ষক নির্ধারিত উত্তরের বাইরে কোনো কিছু শেখার বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হারাচ্ছে আমাদের ছাত্ররা। এর সরাসরি প্রতিফলন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায়। ইংরেজি দূরে থাকুক, বিশুদ্ধ বাংলায় ২০টি বাক্যে একটি অনির্ধারিত বিষয়ে লিখতে পারার মতো ছাত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর মানে কি জাতি মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে? মোটেও তা সঠিক নয়। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে বড় রকমের পদ্ধতিগত ভুল করছি। সেই ভুলগুলো খুব পরিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো শোধরানোর ব্যবস্থা না নিয়ে বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষিত ভর্তি পরীক্ষার কাঠামোকে দোষারোপ করা হচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সত্তা আছে এবং তাদের উচ্চমাধ্যমিকের মেধা ও দক্ষতার ব্যাপারে একটি প্রত্যাশাও আছে। সেই প্রত্যাশাকে নিচে না নামিয়ে কেন আমাদের ছেলেমেয়েরা সেটা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেই অনুসন্ধানটি এখন শুরু করা উচিত এবং তা শোধরানোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তা না হলে আমরা তোতা পাখির জাতিতে পরিণত হব।

ম তামিম: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী।

No comments

Powered by Blogger.