সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য পাহাড়সম by আমানুর রহমান

প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ও ভাতার বৈষম্য পাহাড়সম। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক ৪৭০০ টাকা স্কেলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সাথে রয়েছে সরকারি বিধি অনুসারে নানা ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা। অপর দিকে বেসরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক বেতন পান মাত্র এক হাজার বা তার চেয়ে কিছু বেশি। হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষকের বেতন ৬৪০০ টাকা (সরকারি-বেসরকারি)। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের এর সাথে যুক্ত হয় মূল বেতনের ৫০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া, ৪৫ শতাংশ চিকিৎসা ভাতা, দু’টি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা। আর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামর্থ্য অনুযায়ী ভাতা দেয়া হয় বা হয় না। কোথাও কোথাও বেতন পাঁচ হাজার টাকাও দেয়া হয় না। অপর দিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা সরকারি হারে বেতন পেলেও বাড়ি ভাড়া পান ৫০০ টাকা আর চিকিৎসা ভাতা পান ৩০০ টাকা। কলেজ শিক্ষকেরা ১১ হাজার টাকা মূল বেতনের সাথে সরকারি বিধি অনুসারে ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা পান। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকেরা তাও পান না।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চিত্রটি আরো করুণ। সারা দেশে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে সুযোগ-সুবিধা পান, তার বিপরীতে বেসরকারি বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনভাতা শুধু লজ্জাজনকই নয় অনেক ক্ষেত্রে অপমানজনকও বটে। হাতে গোনা কয়েকটি মানসম্পন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অনেক বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পেলেও বেশির ভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকেরা শিক্ষকদের বেতন ১০ হাজার টাকা দিতেও কুণ্ঠিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নবীন লেকচারার ১১ হাজার টাকা মূল বেতনের সাথে অন্যান্য ভাতাসহ প্রায় ২৩ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন।
এরূপ হাজারো বৈষম্য আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের প্রায় ১২ লাখ শিক্ষক নানামুখী সঙ্কট নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে শিক্ষা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এ বেতনভাতা বৈষম্য যুগের পর যুগ ধরে চলছে। মাঝে মধ্যেই কাসরুম ছেড়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে নামতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকেরা। পুলিশের লাঠিপেটায় লাঞ্ছিত হচ্ছেন মানুষ গড়ার এ কারিগরেরা। এসব কারণে মেধাবীরা আর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
শিক্ষকদের এমন নানামুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে আজ ৫ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস।
সারা বিশ্বের শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা, দায়িত্ব ও কর্তব্য নিশ্চিত করার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে শিক্ষকসমাজ দিবসটি পালন করে আসছেন। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছেÑ ‘শিক্ষকদের জন্য বিনিয়োগ, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ’। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো-আইএলও যৌথ কনভেনশন থেকে শিক্ষক সনদ প্রণয়ন করা হয়। পরে শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষক সংগঠনের অব্যাহত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ফেডারিক মেয়র। সে থেকে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক নেতারা বলছেন, মহান পেশা শিক্ষকতা এখন আকর্ষণহীন। বেতন বৈষম্যের কারণে মেধাবীরা এখন আর শিক্ষকতায় আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না। দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়ছে। তাই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। 
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আফ্রিকার দরিদ্র দেশেগুলোর চেয়েও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম বাংলাদেশে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় সার্কভুক্ত নেপাল, ভুটানে যেখানে শিক্ষা খাতে বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশে বরাদ্দ বাজেটের মাত্র ১১ শতাংশ। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ (কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বরাদ্দ মিলে) আরো বেশি। শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে সচেষ্ট দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি হলো মালদ্বীপ। জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছে এ দেশটি।
ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক আবদুস সাত্তার বলেন, ১০ বছর ধরে তিনি শিক্ষকতা করছেন। তিনি জানান, ইবতেদায়ি শিক্ষকেরা মাসে এক হাজার টাকা ভাতা ও ২০০ টাকা মহার্ঘ্য ভাতা পান। এটি প্রতি মাসে দেয়া হয় না। তিন মাস পরপর দেয়া হয়। তিনি বলেন, একজন দিনমজুরও মাসে নয় থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করেন। তারা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কারিগর (শিক্ষক) হয়েও তাদের বেতন মাত্র এক হাজার টাকা।
এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি ও প্রবীণ শিক্ষক প্রফেসর মাযহারুল হান্নান নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাপনায় বৈষম্য ও শিক্ষা জাতীয়করণ না করা হলে শিক্ষার কাক্সিক্ষত মান অর্জন হবে না এটি সরকারের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত এনজিওগুলোর সংগঠন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকারীকরণ করা হলেও শিক্ষকদের বেতনভাতায় বৈষম্য আছে। বেসরকারি শিক্ষকদের চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৩০০ টাকা আর বাড়ি ভাড়া ৫০০ টাকা। এ ভাতা কোনোভাবেই যুক্তির মধ্যে পড়ে না। ৫০০ টাকায় বাড়ি ভাড়া যেমন অযৌক্তিক, কোচিং বাণিজ্য নিয়ে শিক্ষকদের দায়ী করাও তেমন অযৌক্তিক। তিনি বলেন, শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। এর প্রভাব শিক্ষা ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। উচ্চতর শিক্ষায় প্রবেশ পথে শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় পাসও করতে পারছে না। কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ভিত্তিটাই নড়বড়ে। শিক্ষার বড় চালিকাশক্তি শিক্ষক এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক চাকরিতে প্রবেশকালে বেতন পান ২০ হাজার রুপি। তিনি বলেন, মাধ্যমিকপর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য হয়। সরকার বদলের সাথে সাথে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি সরকারের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্য হচ্ছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও নীতিনির্ধারকেরাও জানেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষকের নৈতিকস্খলনের উদাহরণ দিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, অনৈতিকভাবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের কাছে নৈতিকতা আশা করা যায় না।  
এ দিবসের কর্মসূচি : সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠন ও এনজিওগুলো শিক্ষক দিবস পালনের জন্য জাতীয় উদযাপন কমিটি করেছে। এর আহ্বায়ক হচ্ছেনÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও সমন্বয়ক হচ্ছেন প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ। তারা আগামী ২০ অক্টোবর এ দিবসের কর্মসূচি পালন করবে। ওই দিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে র‌্যালি বের করা হবে এবং বিকেলে টিএসসি মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে শিক্ষামন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের একক বৃহৎ শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট আগামী ১৩ অক্টোবর সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস কাবে আলোচনা ও সেমিনারের আয়োজন করেছে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূঁইয়া বলেন, শিক্ষকদের জন্য বর্তমান সরকার উল্লেখযোগ্য ও ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নেননি, বরং শিক্ষকেরা ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবির আন্দোলন করতে গেলে নানাভাবে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.