দুর্ঘটনার কারণ সড়ক অব্যস্থাপনা by সাহস রতন

বাংলাদেশে গাড়ি চালানো এক বিশাল ব্যাপার। আমাদের ড্র্রাইভাররা অনেক এক্সপার্ট। এটা আমার কথা না। বিদেশবিভূঁইয়ে যারা থাকেন এটা তাদের অনেকের স্বীকারোক্তি। বাংলাদেশে রাস্তার পরিমাণের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। তারও বেশি যাত্রীর সংখ্যা। উপরন্তু রাস্তায় ট্রাফিক ভলিউম ও লোড অত্যধিক। একবার ভাবুন তো- দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে গাড়ি। প্রচণ্ড গরম। গাড়িতে এসি নেই। দরদর করে ঘামছে সবাই। এরই মধ্যে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মতো বিকট শব্দে বাজছে হর্ন। একই পথে পাশাপাশি চলছে রিকশা, অটোরিকশা, বাস, ট্রাক, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, জিপ ও মাইক্রোবাস। প্রত্যেকের গতি আলাদা। তার ওপর যে রাস্তায় তিনটা গাড়ি চলার কথা সেখানে পাঁচটা গাড়ি ঢুকে পড়েছে। এসব ক্ষেত্রে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কি বলবেন? ভাগ্যিস ব্যাপারটা ঘটে শহরের ভেতরের রাস্তায়- এ জন্যই রক্ষা। কিন্তু এভাবে চলতে গিয়ে ড্রাইভারদের বিরাট একটা অংশ উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের অসুখে ভুগছেন। প্রচলিত অর্থে দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত চালকই দায়ী। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু কি ড্রাইভারই দায়ী? এর জন্য কি আমাদের সড়ক অব্যবস্থাপনাও কোন অংশে দায়ী নয়? বিগত দিনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো আমলে নিলে দেখা যাবে, ড্রাইভার যতটা দায়ী, ঠিক ততটাই দায়ী সড়ক অব্যস্থাপনা। মহাসড়কঘেঁষে অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গড়ে উঠেছে বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ও দোকানপাট। চলছে নানা পদের গাড়ি। হাতের ইশারায় দ্রুতগতিতে চলমান গাড়িকে থামার ইঙ্গিত করে মানুষ রাস্তা পারাপার হচ্ছে অহরহ। মহাসড়কের অনেক স্থানে দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে পাশাপাশি চলছে মানুষচালিত রিকশা, ভ্যান ইত্যাদি। এত কিছুর পরও যে এখনও বেঁচে আছি এর পুরো কৃতিত্ব আমাদের প্রকৃত লাইসেন্সধারী ড্রাইভারদের। আমি নিজে অপেশাদার লাইসেন্সধারী একজন ড্রাইভার। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ড্রাইভ করছি ২০ বছর ধরে। আমার গাড়িতে সহযাত্রী হয়েছেন এমন মানুষের উপলব্ধি, আমি অতি উন্নতমানের ড্রাইভার। আমি নিজেও বিশ্বাস করি, চালক যদি ট্রাফিক সাইনগুলো বোঝে এবং তা মেনে চলে, তাহলে বর্তমান ব্যবস্থায়ও অনেক দুর্ঘটনা ও ট্রাফিক জ্যাম এড়ানো সম্ভব। তবে এর জন্য প্রথম যা দরকার তা হলো- ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা। অনেকেই হয়তো দ্বিমত করবেন, তবে আমি মনে করি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য লিখিত পরীক্ষা অত্যাবশ্যক নয়, যা জরুরি তা হলো ট্রাফিক সাইন, সিগন্যাল, লেন মার্কিং- এসব জানা, বোঝা ও মানা। কারণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক গবেষণা করে ট্রাফিক সাইনগুলো এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও যে কেউ খালি চোখে দেখেই এ সাইনগুলো বুঝতে পারে। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে অবশ্যই মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় পাস করতেই হবে। কোন অজুহাতেই এ শর্ত শিথিলযোগ্য নয়। মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে, লাইসেন্সপ্রার্থী ট্রাফিক সাইন, সিগন্যাল, লেন মার্কিং ও ট্রাফিক আইন এগুলো বোঝে। দুঃখজনক হলো, কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে নানা অজুহাতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্তদের বিরাট অংশ ট্রাফিক সাইন, সিগন্যাল, লেন মার্কিং ও ট্রাফিক আইন এসব কিছুই বোঝে না। ফলে রাস্তাগুলো হয়ে পড়েছে বিপদসংঙ্কুল ও মরণফাঁদ।
নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় পাস করতে হলে ট্রাফিক সাইন ও আইনগুলো জানতে হয়। আর জানা থাকলেই কেবল মেনে চলা যায়। বর্তমানে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ড্রাইভারদের বিরাট একটা অংশ ট্রাফিক সাইন ও আইনের মৌলিক বিষয়গুলোই জানে না, মানবে কি? ভুয়া বা নকল লাইসেন্সধারী ড্রাইভারগুলোই মূলত দুর্ঘটনা ঘটায়। তাই যত দ্রুত সম্ভব, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। পাশাপাশি বর্তমানে যারা নকল লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালাচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সব ধরনের ড্রাইভারের জন্য জীবন বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তবেই কেবল দুর্ঘটনা এবং জ্যাম থেকে রেহাই পাবো আমরা। তা না হলে ১০টা লেন আর ১০০টা ফ্লাইওভারেও কোন ফায়দা হবে না।

No comments

Powered by Blogger.