ভালোবাসার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় by রাজীব মীর

আজ ২০ অক্টোবর, নবম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এর রয়েছে ১৫৬ বছরের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের নাম বদল করে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী তাঁর বাবার নামে ১৮৭২ সালে জগন্নাথ স্কুল নামকরণ করেন। ১৮৮৪ ও ১৯০৮ সালে যথাক্রমে এটি দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। এ সময় এটিই ছিল ঢাকার উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৫’ পাসের মাধ্যমে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২৭/৪ ধারার বাতিলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং পাঁচ শতাধিক শিক্ষক বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের ৩১টি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউট শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখছেন। অল্প কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি সবার নজর কেড়েছে। শিক্ষার্থীদের ভর্তির আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সামনে এগোতে আশাবাদী করে তুলেছে। শিক্ষকদের বেশির ভাগই তরুণ, মেধাবী ও পরিশ্রমী। এটিও অনেক বড় ভরসার জায়গা। সেমিস্টার সিস্টেমে পড়াশোনা ছাড়া পাসের বিকল্প নেই। শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নেই বললেই চলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেই সময় ও ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় সবাইকে। পুরান ঢাকার দীর্ঘ যানজট অসহনীয়। প্রচুর সময় ব্যয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতে। পর্যাপ্ত পরিবহনসুবিধার অভাব এবং একদমই আবাসিক সুবিধা না থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকেই সমস্যা পোহাতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা নেই অথচ এর ১২টি বেদখল হল রয়েছে। ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে দু-একটা হল উদ্ধার হলেও আমলাতান্ত্রিক ও আইনি জটিলতার কবলে পড়ে আবাসিক অসুবিধা নিরসনের গতি ততটা সচল হচ্ছে না। যদিও ইতিমধ্যে একটি ছাত্রীহলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিসরের আয়তন ছোট হওয়ায় ক্লাসরুমের সংকটও খুব বেশি। শিক্ষকদের বসার জায়গা স্থানাভাবে সংকুলান হচ্ছে না। বরাদ্দ কম থাকায় গবেষণা কার্যক্রমও পর্যাপ্ত হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল, কলাভবন এবং ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ওয়াই–ফাই সুবিধা থাকায় শিক্ষার্থীরা সহজেই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু জগন্নাথে ওয়াই–ফাই-সুবিধা নামে থাকলেও কাজে আসছে না। তাই শিক্ষার্থীদের তথ্য মহাসড়কে অভিগম্যতার সুযোগ তুলনামূলক কম। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি ক্লাসের সময়েই (অর্থাৎ সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা) পর্যন্ত খোলা থাকায় শিক্ষার্থীরা অধিকতর সময় ধরে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ক্লাসের সময়ের বাইরেও গ্রন্থাগারটি খোলা রাখতে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হবে, আশা করি। আবার ছাত্রদের জন্য কোনো জিমনেসিয়াম না থাকায় অভ্যন্তরীণ শরীরচর্চার অনুশীলন ব্যাহত হচ্ছে। উপরন্তু টিএসসি না থাকায় স্থায়ী সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বেগবান হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণতর হচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক হল উদ্ধার আন্দোলনের ফলে টিএসসি করার একটি স্থান আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে টিএসসি স্থাপন বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনের দশাও বেহাল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই। মাত্র একজন চিকিৎসক ও চিকিৎসা সহকারী নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বিশাল চিকিৎসা-সুবিধা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি খেলার মাঠও রয়েছে। সেখানে খেলাধুলার আয়োজন হচ্ছে নিয়মিত। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আছে বলা যাবে না। বর্তমান প্রশাসন এ বিষয়ে সজাগ ভূমিকা রাখছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম সোসাইটি সুনামের সঙ্গে নিয়মিত তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। যদিও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যানারে ছাত্রনেতাদের নাম না থাকলে বা তাঁদের অতিথি করা না হলে সে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে যায়। ভয়াবহ হলো শিক্ষক লাঞ্ছনা। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকদের বিব্রত করে, বিরক্ত করে। শ্রেণিতে উপস্থিতির নম্বর, পরীক্ষার খাতার নম্বর বাড়ানোর আবদার বা টেন্ডারসংক্রান্ত জটিলতায় শিক্ষক এবং শিক্ষক-প্রশাসকেরা অত্যন্ত আতঙ্কে থাকেন। একটি শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেন্দ্র শিক্ষক-শিক্ষার্থী দূরত্ব কমাতে সহায়ক হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া পার্ক, পরে যা বাহাদুর শাহ পার্ক নামে পরিচিত, সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা বিনোদনের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হতে পারে এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাততলাবিশিষ্ট ভবনটির সামনে রয়েছে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য। ভাস্কর রাশা নির্মিত ভাস্কর্যটির একপাশে চিত্রিত রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। আর অপর পাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যা। ভাস্কর্য থেকে সামনে এগোলেই দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার। এর উত্তর দিকে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশ ভবন। আর দক্ষিণ দিকে আছে পুরোনো বিজনেস স্টাডিজ ভবন, যা এখন ভাষাশহীদ রফিক ভবন। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ছয় দফা ও ১১ দফা ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলনেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। আজও আন্দোলন চলছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলেই ছাত্রাবাসের জন্য কেরানীগঞ্জে সরকারি ৬ দশমিক ৬৯ একর খাসজমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত ফাইল শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশসহ এখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। আমরা আশাবাদী। বর্ণিল সাজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর আলোচনায় সমবেত হোক প্রাণ, জাগুক স্পন্দন—জ্ঞান ও গর্বের।
রাজীব মীর: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.