অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ আর নেই- চলে গেলেন ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী

বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল নব্বইয়ের কোঠা। তবু বেশ সুস্থই ছিলেন তিনি। চলেফিরে বেড়াতেন কারও সাহায্য ছাড়াই। কিন্তু অনেকটা আকস্মিকভাবেই চলে গেলেন মানবতাবাদী ঐতিহাসিক জাতীয় অধ্যাপক এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ। গতকাল রোববার ৯২ বছর বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বিপত্নীক অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ রাজধানীর বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের ২২ নম্বর বহুতল বাড়ির নিজস্ব ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। তাঁর প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠজন অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যার সুস্থই ছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো। গতকাল সকাল সতাটার কিছু আগে তাঁর দেখভালকারী টেলিফোনে আমাকে জানান যে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’ তিনি দ্রুত ওই বাড়িতে গিয়ে দেখেন সালাহউদ্দীন আহমদের চক্ষু স্থির, শরীর ঘামে ভেজা । ঠান্ডা হয়ে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎকেরা জানান, প্রবীণ অধ্যাপক আর নেই। সম্ভবত সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সালাহউদ্দীন আহমদের মৃত্যুর খবরে শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গুণগ্রাহী তাঁর বাসভবনে ছুটে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁর বাসায় গিয়ে অন্তিম শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে কিছু সময় অবস্থান করেন। এ ছাড়া এসেছিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দীন উমরসহ অনেকেই। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেলা তিনটায় তাঁর মরদেহ আনা হয় সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। প্রথমেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবুল হোসেন পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর শোকবার্তায় মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বলেছেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদিন। প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে জাতি প্রকৃতপক্ষে একজন অভিভাবককে হারাল। তাঁর অবদানের কথা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।’ এরপর বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সুহৃদ ও অনুরাগীরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের পক্ষে জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশীদ, সংস্কৃতিসচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাস, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষে নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ অনেকে। প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের মধ্যে ছিল বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাসদ, জাতিসংঘ সমিতি, ইতিহাস পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, প্রথম আলো প্রভৃতি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের অবদানের কথা তুলে ধরে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিহাসের যে মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাংস্কৃতিক গুণাবলি রয়েছে, তা প্রয়োগ করে তিনি ইতিহাসচর্চা করেছেন। আমাদের ও তাঁর ছাত্রদের এভাবেই ইতিহাসচর্চায় অনুপ্রাণিত করেছেন।’ অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ বলেন, ‘একটি জাতি যখন ইতিহাস বিকৃতির খেলায় মেতে থাকে, সেখানে তাঁর মতো একজন সত্যানুসন্ধানী ইতিহাসবিদকে হারানোর ক্ষতি অপূরণীয়। উনিশ শতকে বাঙালি রেনেসাঁসের যে সূচনা হয়েছিল, এ বিষয়ে তাঁর গবেষণা ও মূল্যায়ন অত্যন্ত মূল্যবান।’ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। শুধু একজন মানবদরদী ইতিহাসবিদই নন, জাতির সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁকে হারিয়ে আভিভাবকে হারিয়েছি।’ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘উপমহাদেশের খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ছিলেন তিনি। যৌবনেই এম এন রায়ের সংস্পর্শে এসে মানবিকতাবোধে অনুপ্রাণিত হন। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সম্প্রাদায়িক সহিংসতার সময় নোয়াখালীতে কাজ করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে তাঁর অভাব পূরণ হওয়ার নয়।’ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর মরদেহ আনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। এখানে বাদ আসর জানাজার পর বনানী কবরস্থানে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী: অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২২ সালে, ফরিদপুরে (তবে তাঁর শিক্ষা সনদে জন্ম সাল উল্লেখ রয়েছে ১৯২৪)। পিতা আবু আহমদ ফজলুল মহী। কলকাতার তালতলা হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৩৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, রিপন কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে উচ্চমাধ্যমিক, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণা করেন। পিএইচডি করেন লন্ডনে। সালাহউদ্দীন আহমদ জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৪৮ সালে। এখানে তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৯৫৪ সালে ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন এবং এখানে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ১৯৭৮ সালে এবং ১৯৮৪ সালে নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর নেন। তবে পরে তিনি সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি, ইতিহাস পরিষদ, জাতিসংঘ সমিতি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ইত্যাদি। রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ: জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ইতিহাসের সন্ধানে ইত্যাদি। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ বিভিন্ন পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
শোক: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, রেজিস্ট্রার ফেরদৌস আলী ও শিক্ষকেরা। এ ছাড়া শোক প্রকাশ করেছে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন।

No comments

Powered by Blogger.