দু’দশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও নিম্ন আয়ের দেশ

গত দু’দশকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও একটি নিম্ন আয়ের দেশ। লক্ষাধিক মানুষ এখনও বসবাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অন্য দেশ ও বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য নির্মূলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বিশ্বের অনেক দেশের জনগণ অবস্থান করছে। মাথাপিছু আয় অনেক কম। এমন সব কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে চরম দারিদ্র্য দূর করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ: ইনক্লুসিভ গ্রোথ ডায়াগনোস্টিক জুন ২০১৪’ শীর্ষক ১৯৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, লক্ষাধিক মানুষের দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রসারের মাত্রা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশে। উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার একাধিক সময়কাল। রাষ্ট্র হিসেবে ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্যে পৌঁছুতে হলে তাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হার হতে হবে ৭.৫-৮ শতাংশ। বাংলাদেশ যদি আয়ের মাত্রা বৃদ্ধি ও চরম দারিদ্রতা বিমোচন করতে চায় তাহলে এ প্রবৃদ্ধিতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে দেশবাসী ও নারীদের উন্নয়ন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের গড় জাতীয় আয় বেড়েছে। ২০০০ সালে মাথাপিছু গড় আয় ৯৮৫ ডলার থেকে ২০১০ সালে ১৭৬৮ ডলারে উন্নীত হয়েছে। তথাপি বাংলাদেশ এখনও একটি নিম্ন আয়ের দেশ। লক্ষাধিক মানুষের বাস এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে। ২০১০ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দারিদ্র্যসীমার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড দৈনিক ১.২৫ ডলারের নিচে আয় ৪৩ শতাংশ মানুষের। বাস্তবতার নিরিখে ২০১০ সালে প্রায় ৬ কোটি ৫০ লাখ বাংলাদেশী চরম দরিদ্রতায় দিনাতিপাত করেছে, যা কিনা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। এছাড়াও দারিদ্র্যসীমা থেকে কিছুটা উপরে এমন জনসংখ্যার হারও বাংলাদেশে অনেক বেশি। বাস্তবিক অর্থে এসব মানুষও আর্থিক টানাটানিতে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ২০১০ সালে ৫ কোটি বাংলাদেশীর আয় ছিল দিনপ্রতি ১.২৫ ডলারের উপরে, কিন্তু ২ ডলারের নিচে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দরিদ্রতা বিমোচনে দৃঢ়সংকল্প নিয়েছে। বড় ধরনের কোন ধাক্কা না খেলে এবং ২০০০ সাল থেকে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দরিদ্রতার বিস্তার ২.৪ শতাংশ প্রতিহত করতে পারবে। একইসঙ্গে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, ‘চরম দরিদ্রতা’ নিয়ে যে আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা নিরুপণ করা হয় সেটা হলো বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর দরিদ্রসীমার গড়ের আপেক্ষিক দরিদ্রমাত্রা যা অত্যন্ত কম। অর্থাৎ দৈনিক আয় ১.২৫ ডলারের উপরে ওঠার অর্থ কোন ভাবেই দরিদ্রমুক্তি নয়। বরং সেটা হলো আগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম দরিদ্রের অবস্থায় যাওয়া। যদিও ২০৩০ সালের মধ্যে দৈনিক ১.২৫ ডলার মানদণ্ডে বাংলাদেশ ২.৪ শতাংশ দরিদ্রতা কমিয়ে আনতে পারলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক অর্জন। আর সেটা অর্জন করতে সক্ষম হলে পরেও দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের দৈনিক আয় থাকবে ৪ ডলারের কম। সংক্ষেপে দাতা দেশগুলোর নাগরিকরা যেভাবে দেখে থাকেন সে অর্থে বাংলাদেশীদের দরিদ্রমুক্তির জন্য প্রয়োজন হবে দশকের পর দশক ধরে অব্যাহত ও সমাজের সকল শ্রেণীর অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি। ফলে নীতিমালা ও কার্যক্রমগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের পাশাপাশি মধ্য মেয়াদি লক্ষ্য থাকতে হবে। এ বিশ্লেষণের লক্ষ্য হলো- ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিনিয়োগ ও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় আয় বৃদ্ধি হতে পারে এমন ঝুঁকি নেয়ার ক্ষেত্রে কি কি প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে সেগুলো চিহ্নিত করা। সুনির্দিষ্ট হস্তক্ষেপের নির্দেশনা দেয়া এ বিশ্লেষণের লক্ষ্য নয়, বরং উন্নয়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলোর ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করতে একটি কাঠামো দেয়াটাই এর উদ্দেশ্য। এ বিশ্লেষণকে কাজে লাগিয়ে নীতিনির্ধারকরা যথাযথ সংস্কার ও প্রকল্প চিহ্নিত করতে পারবেন যেখানে প্রতিবন্ধকতা সহজে অতিক্রম করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চাঙ্গা করা সম্ভব। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস ইনডেক্স তাদের ২০১৩-২০১৪ রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশে বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় বাধা বা সমস্যা হলো দুর্নীতি। এতে দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর সুবিধা। রয়েছে সরকারি পর্যায়ে অকার্যকারিতা ও অর্থের অভাব। বাংলাদেশ ঘুষ, দুর্নীতিতে রয়েছে অনেকটা তলানিতে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো বিদ্যুৎ। এখানে বিদ্যুতের মূল্য অনেক বেশি। সুশাসনকেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের একটি বড় নিয়ামক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়ে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মূল্য দিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

No comments

Powered by Blogger.