লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতির সাতকাহন by দীন ইসলাম

বিতর্কিত ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর অব্যাহত দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মতিঝিলে চট্টগ্রাম সমিতিকে এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে জমি ইজারা, ক্ষমতার অপব্যবহার করে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়াসহ নানা বিষয়ে তার দুর্নীতির সাতকাহন রূপকথাকে যেন হার মানিয়েছে। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর মিডিয়াতে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসব বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তার দুর্নীতির সত্যতা পায়। টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রী হওয়ার পর ‘ভিওআইপি’ কেলেঙ্কারির সঙ্গেও জড়িয়ে যান লতিফ সিদ্দিকী। এ কারণে খোদ মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ধমক দেন লতিফ সিদ্দিকীকে। এরপর থেকে সব সময় মন্ত্রিসভা বৈঠকে সরব থাকা লতিফ সিদ্দিকী চুপসে যান।

চট্টগ্রাম সমিতিকে অনিয়মতান্ত্রিক জমি ইজারা: ২০০৮ সালের মহাজোট সরকারের আমলে লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এ মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময়ে ২০১৩ সালে ক্ষমতা ছাড়ার চার দিন আগে নিয়মবহির্ভূতভাবে ঢাকার মতিঝিলে চট্টগ্রাম সমিতিকে জমি ইজারা দেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় জমির ইজারা দেয়ার বিষয়ে এখন বলছে, তখনকার মন্ত্রীর ইচ্ছায় এটা হয়েছিল এবং এটি ছিল মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১১ই জুন চট্টগ্রাম সমিতি হাসপাতাল বানানোর কথা বলে জমির জন্য আবেদন করে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার চার দিন আগে গত বছরের ২০শে অক্টোবর তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী তাতে সম্মতি দেন। পরদিন ২১শে অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নীলরতন সরকার চট্টগ্রাম সমিতির তখনকার সভাপতি রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাককে একটি চিঠি দিয়ে জমিটি ইজারা দেয়ার কথা জানান। ইজারা মূল্য প্রতিবছর এক লাখ এক হাজার ১০১ টাকা হিসেবে ৯৯ বছরের জন্য এক কোটি এক লাখ এক হাজার ১০১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর ১২ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার শপথ নেয়। তার তিন দিনের মাথায় ১৫ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম সমিতিকে জমিটি ইজারা দলিল করে দেয় মন্ত্রণালয়। দলিলে দেখা যায়, জমিদাতা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব ফণীভূষণ চৌধুরীকে দাতা এবং গ্রহীতা চট্টগ্রাম সমিতির পক্ষে এর ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ও নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি লায়লা সিদ্দিকী এবং সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দীন খান এবং ট্রাস্ট সেক্রেটারি এম এমদাদুল ইসলাম। জমিটি ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার আড়াই মাস পর চট্টগ্রাম সমিতির দ্বিবার্ষিক নির্বাচন হয়। এতে ২০১৪-১৫ সালের জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হন লায়লা সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দীন খান। জমিটি ইজারা অনুমোদনের নথিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী লেখেন, মেজবান চট্টগ্রাম সমিতির একটি আকর্ষণীয় বাৎসরিক অনুষ্ঠান। ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলা কন্যার পাণি গ্রহণ করেছি। ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। তাদের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় এই ভূমি খণ্ডটির প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবতার সেবায় তাদের সহযোগিতা করার নৈতিক দায়িত্ববোধ মনে করছি। লতিফ সিদ্দিকীর এ অনিয়মতান্ত্রিক ইজারার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে এর সত্যতা পায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব নীলরতন সরকারের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, এই প্লটটি বিক্রির কোন এখতিয়ার বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নেই। এই মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর লিখিত নির্দেশে ওই ইজারা দেয়া হয়। এতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শর্তও মানা হয়নি। এই জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অবমুক্ত করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। অবমুক্ত করার ক্ষেত্রে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দু’টি শর্ত দেয়। তা হলো, প্লটটি কখনও বিক্রয় ও হস্তান্তর করা যাবে না এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে এটি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর কোনটিই মানা হয়নি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের এমন ভূমিকার কারণে চট্টগ্রাম সমিতি এখনও জমিতে দখলে যেতে পারেনি।
মন্ত্রিসভার সদস্যরা অতিষ্ঠ, প্রধানমন্ত্রীর ধমক: লতিফ সিদ্দিকীর আচরণে মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছিলেন অতিষ্ঠ। যখন তখন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের আক্রমণ করতেন তিনি। মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে বিতর্কে জড়ান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় অনেক বিতর্ক নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে কয়েকবার ধমকের সুরে কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর কথা শুনে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে যান। যদিও প্রধানমন্ত্রী বাদ সাধার কারণে বিষয়টি বেশি দূর এগোয়নি। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কয়েকটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে সরব থাকলেও এরপর চুপসে যান। একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০শে জুন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে অবৈধভাবে ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) ব্যবসা পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ধমক খান লতিফ সিদ্দিকী। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বলেন, কারা ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তা আমার নলেজে আছে। কার ছেলে, কার মেয়ে, কার জামাই এ ব্যবসা করেন সবই আমার জানা আছে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় কাউকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী যখন এসব কথা বলছিলেন তখন লতিফ সিদ্দিকী চুপ করে বসেছিলেন। তিনি কোন শব্দ করেননি। এছাড়া, লতিফ সিদ্দিকীর কিছু টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে নেয়া হয়েছিল। ওই সব রেকর্ড নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৩০শে জুনের মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর অনেকটা চুপসে যান লতিফ সিদ্দিকী। মন্ত্রিসভা বৈঠকে এসে চুপ মেরে বসে থাকতেন। এরপর থেকেই নিজের অবস্থান দুর্বলের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন সরকারের এ মন্ত্রী।
অনিয়মতান্ত্রিক ঋণ ও ঋণ মওকুফ: বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে গাড়ি- ও ফ্ল্যাট কেনা এবং ব্যবসা ?করার জন্য ঋণ দেয়া হয়। ঋণগ্রহীতা দু’জন ছিলেন একই মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং একজন নারী উদ্যোক্তা। ঋণ দেয়ার জন্য সুপারিশ ও অনুমোদন দু’টোই করেছেন মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এমনকি নারী উদ্যোক্তাকে দেয়া ঋণ মওকুফও করেন তিনি। সরকারের তরফে এর তদন্তে বলা হয়, এভাবে টাকা দেয়ার কোন বিধান নেই। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এ সংস্থাকে কেউ ঋণ দিতে পারে না।
অস্থির অবস্থায় তার দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা: সব সময় অস্থির অবস্থায় রয়েছেন লতিফ সিদ্দিকীর দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্যে টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি অস্থিরতায়। টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানালেন, মন্ত্রণালয়ে অনেকটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। নয় মাসের মধ্যে তিনি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে ভয়-ভীতির জন্ম দেন। ওদিকে মোবাইল ফোন অপারেটর সংস্থার কাছে অর্থ চাওয়া নিয়ে টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ে নানা কথা চালু রয়েছে। সমপ্রতি টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমি চাঁদা নিই। কারণ রাজনীতি করতে আমাকে চাঁদা নিতে হয়। তবে কমিশন খাই না।

No comments

Powered by Blogger.