হিল্লা বিয়েতে রাজি না হওয়ায়...

সাংসারিক বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি। একপর্যায়ে উৎসুক প্রতিবেশীর আগমন এবং স্বামী উত্তপ্ত মাথায় উচ্চারণ করলো তালাক। কথাটি চলে গেল মাতব্বরদের কানে। আর পরিবারটির বিরুদ্ধে জারি হলো হিল্লা বিয়ে এবং দোররা মারার ফতোয়া। তাতে রাজি না হওয়ার ফল সমাজচ্যুত(একঘরে)। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বিন্নাচাপড় গ্রামের ৬টি পরিবার ভাগ্যে তাই হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের সমাজে আর ঠাঁই হয়নি। সমাজপতিদের ভয়ে এবং লজ্জায় মুখ খুলতে পারেন না আরও অনেক পরিবার। ফতোয়াবাজ আর মাতব্বরদের দৌরাত্ম্যে গুমরে কাঁদছেন এই উপজেলার গ্রামগুলোর অনেক নিরীহ পরিবার। সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে আবারও সমাজে ফিরে সামাজিকভাবে বাঁচতে চায় পরিবারগুলো। ফতোয়াবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন এলাকাবাসী।

১৭ বছর যাবৎ সমাজচ্যুত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাজুল ড্রাইভার। ৪ থেকে ৭ বছরের মধ্যে রয়েছেন এরফান, মিন্টু, দেলোয়ার হোসেন, জিয়াউর, মিরাজুলের পরিবার। প্রত্যেকের সংসারে আছে সন্তান, জামাই, নাতি নাতনি। শ্রম বিক্রি এবং সমাজের কোন লোকের দোকান থেকে কিছু কিনতে পারলেও আচার অনুষ্ঠানে তাদের রাখা হয় না। ফতোয়াদাতাদের মধ্যে রয়েছেন গ্রামের মসজিদের ইমাম আনিছ মাওলানা, অন্য গ্রামের ইমাম আহম্মদ মাওলানা, ওই ইউনিযনের ২নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আবদুর রহমান বাঘা, সাবেক আরেক সদস্য আকবর, মাতব্বর তাজুল, মোমিন, ইকবাল, ইউছুফ।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানায়, দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পরে তুচ্ছ ঘটনায় বিভিন্ন সময় স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় প্রতিবেশীরা ভিড় করে। রাগের মাথায় স্ত্রীর প্রতি তারা তালাক শব্দটি উচ্চাণ করেছেন। কথাটি রাগের মাথায় বললেও মনে থেকে বলেননি বলে তারা জানান। সেই কথা শুনে প্রতিবেশীদের কেউ মাতব্বরদের কাছে বলে দেয়। মাতব্বররা তাদের শুদ্ধি হওয়ার জন্য মাওলানাদের কাছে গিয়ে উপায় জেনে আসতে বলে। গ্রামের মসজিদের ইমাম আনিছ মাওলানা এবং অন্য গ্রামের ইমাম আহম্মদ মাওলানার কাছে গেলে হিল্লা বিয়ের কথা বলেন। পর পুরুষের সঙ্গে বিয়ে এবং ৩ মাস পরে হিল্লা বিয়ের স্বামী যদি আবার তালাক করে তাহলে আগের স্বামীকে দোররা মারার পরে আবারও বিয়ের মাধ্যমে শুদ্ধি হওয়া যাবে। ফতোয়ায় রাজি না হওয়ায় ওই ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আবদুর রহমান বাঘা, সাবেক আরেক সদস্য আকবর, মাতব্বর তাজুল, মোমিন, ইকবাল, ইউছুফ গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে তাদের সমাজচ্যুত করে। সমাজের মানুষের কাছে শ্রম বিক্রি এবং তাদের দোকান থেকে কেনাকাটা করা গেলেও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে তাদের রাখা হয় না। কোরবানির ঈদে তাদের বাড়িতে সমাজের মাংস পর্যন্ত আসে না। বঞ্চিত করা হয় বিয়ে, মিলাদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে। তাজুল ড্রাইভারের মেয়ের বিয়েতে আসেনি সমাজের কেউ। তার ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া নাতনি মনজেলাকে দেয়া হয়নি উপবৃত্তির কার্ড। ফতোয়ার নির্যাতনে এভাবেই কেটে যাচ্ছে তাদের বছরের পর বছর। সমাজে ফিরিয়ে নিয়ে সামাজিকভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার জন্য ভুক্তভোগী পরিবারগুলো প্রশাসনের কাছে দাবি রেখেছেন। এলাকাবাসী জানান, ফতোয়া দেয়া অপরাধ তারা শুনেছেন। আর সংসার ভাঙার ফতোয়া যারা দেয় তারা অপরাধী এবং জঘন্য পাপী। এসব ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেছেন তারা।
পরিস্থিতির শিকার তাইজুল-মোর্শেদা দম্পতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দীর্ঘ ১৮ বছর যাবৎ তাদেরকে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। তারা মাতব্বরদের অনেক অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। মাতব্বরদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ তুলে ইরফান-সুফিয়া দম্পতি বলেন, তাদেরকে দীর্ঘ ৭ বছর যাবৎ সমাজচ্যুত করা হয়েছে। কোরবানির সময় সমাজের সদস্য হিসেবে তাদেরকে গোশত দেয়া হয় না। অপরদিকে মিন্টু-ফেন্সি দম্পতি ৪ বছর যাবৎ, দেলোয়ার হোসেন ওরফে দুলু-সাফিনা দম্পতি ৩ বছর যাবৎ, জিয়াউল-শাহিনুর দম্পতি ৬ বছর যাবৎ এবং সিরাজুল-সুমি দম্পতি ৩ বছর যাবৎ সমাজচ্যুত রয়েছেন। মিন্টু জানান, ইমাম মাওলানা আনিছ তার স্ত্রীকে অন্যজনের সঙ্গে ৩ মাসের জন্য বিয়ে দেয়ার কথা বলেছিল। পাশাপাশি সামাজিকভাবে ১০১টি দোরার মারার কথা বলেছিল। আমি তাতে রাজি হইনি। ওই ঘটনার বিচারক সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল রহমান বাঘার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি কোন বক্তব্য না দিয়ে পালিয়ে যান।
ওই ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য আবদুল মোত্তালেব ফেরদৌস জানান, বিষয়টি তিনি আগে যানতেন না। প্রয়োজনে যাবেন এবং সমাধানে যা করণীয় তাই করবেন। শাজাহানপুর থানার ওসি আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, সমাজচ্যুত করার বিষয়টি জানার পরপরই বিন্নাচাপড় এলাকায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে ঘটনার তদন্ত করিয়েছি। সংশিষ্টরা অভিযোগ দিলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রুবায়েত খান জানিয়েছেন, সমাজচ্যুত করার ঘটনা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে থানার ওসিকে বলেছি। তাছাড়া তিনি সরেজমিন ওই এলাকা পরিদর্শন করবেন বলেও জানান।

No comments

Powered by Blogger.