শিক্ষায় বৈষম্য by শামীমুল হক

সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি/আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে/আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে। ছোটবেলায় জোরে চিৎকার করে অন্য শিশুদের মতো আমরা দু’ভাইবোনও পড়েছি এই কবিতা। মুখস্থ করেছি। শুধু তাই নয়, মা এসে বলতেন, ‘শুধু মুখস্থ করলেই হবে না, এই কবিতার মতো তোমরা নিজেরাও চলবে।’ চলতে পেরেছি কিনা সেদিকে যাচ্ছি না। তবে, আমার সন্তানদের শিশুবেলায় চিৎকার করে পড়তে শুনেছি-আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে/ ঢাক ঢোল ঝাঁঝর বাজে/ বাজতে বাজতে চললো ঢুলি/ ঢুলি গেল কমলাফুলি/ কমলাফুলির বিয়েটা/ সূর্যি মামার বিয়েটা। এই কবিতা পড়ে তারা কি শিখেছে তারাই জানে। শিক্ষকরা কেমন তৃপ্তি পেয়েছেন তারাই বলতে পারেন। ক্লাস থ্রিতে পড়ি। মনে পড়ে নূর মিয়া স্যার বেত নিয়ে ক্লাসে যেতেন। আগের দিনের দেয়া বাড়ির পড়া শিখে না এলে শুরু করতেন মার। নূর মিয়া স্যার ছিলেন খাটো গড়নের। মারতে গিয়ে তিনি লাফাতেন। সেই দৃশ্য এখনও যেন চোখ বুজলে দেখতে পাই। আজ নূর মিয়া স্যার নেই। উনার শেখানো পথে এগিয়ে চলছি। স্যার বলতেন, তোরা বড় হলে আমরা সুখী হবো। আমরা বড় হবো। গর্ব করে বলতে পারবো-ওই যে যাচ্ছে আমার ছাত্র যে কিনা আজ বড় অফিসার। আজ আইন করে শিক্ষকদের ক্লাসে বেত নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোন শিক্ষক কোন শিক্ষার্থীকে বেত দিলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। ফলে শিক্ষকরা আর ক্লাসে বেত নেন না। তাদের কথা- কি দরকার। বেহুদা ঝামেলায় জড়ানো। তার চেয়ে যেমনি আছি তেমনিই থাকি। এতে লাভ অনেক। আগে রাত-দিন পড়েও পাবলিক পরীক্ষায় দেখা গেছে পাস করেছে ৪১ শতাংশ। কিংবা ৩৬ শতাংশ। এখন নাকি লিখলেই পাস। সেই লেখা ভুল কিংবা শুদ্ধ তা দেখা যাবে না। ছাত্র লিখেছে তাকে নাম্বার দিতে হবে। এ অবস্থায় খাতা দেখতে গিয়ে পাসের হার ৯৭ শতাংশ। প্রশ্ন হলো- শিক্ষার হার বাড়ছে ঠিকই, শিক্ষার মান বাড়ছে কি? আগে পরীক্ষা নেয়া হতো বছরে ৪টি। আর পরীক্ষার কথা শুনলেই শিক্ষার্থীদের চাপ বেড়ে যেতো। পড়ালেখায় মনোযোগ বাড়িয়ে দিতো। ফলে যারা পাস করেছে তারা লেখাপড়া করেই পাস করেছে। আর এখন পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে দু’টি। মন্ত্রণালয় থেকে এমন আদেশ পাঠানো হয়েছে জেলা-উপজেলায়। সেখান থেকে স্কুলে স্কুলে। ফলে স্কুলগুলো দু’টোর বেশি পরীক্ষা নিতে পারছে না। কারণ পরীক্ষা নিলেই  উপজেলা শিক্ষা অফিস নড়েচড়ে বসছে। কোথাও কোথাও পরীক্ষা বন্ধ করে দিচ্ছে। এটা হলো গ্রামের চিত্র। কিন্তু শহরে? না, এর কোনটিই পালন করা হচ্ছে না। তারা মডেল টেস্টের নামে ঠিকই ৪টি পরীক্ষা নিচ্ছে। এবং শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপে রাখছে। ফলে শহরের শিক্ষার্থীরা মানের দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা পড়ে থাকছে পেছনেই। শহরে আর গ্রামে সৃষ্টি হচ্ছে বিরাট ব্যবধান। এ ব্যাপারে শহরের এক নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মন্তব্য হলো- মন্ত্রণালয় কি এমনিতেই আমার স্কুলকে সেরা দশে পৌঁছে দেবে? তারা কি এমনিতেই শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ দিয়ে দেবে? না। তাহলে আমি কেন আমার ছাত্রছাত্রীদের ভালর জন্য ব্যবস্থা নেবো না? ১০টি পরীক্ষা নিতে হলে প্রয়োজনে তা-ই নেবো। এখানে মন্ত্রণালয় উপদেশ দেবে কোন যুক্তিতে? অন্যদিকে গ্রামে অবস্থিত এক মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য- কি করবো? দু’টি পরীক্ষার ব্যবস্থা মানে হলো শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় অমনোযোগী করে  তোলা। আমরা এর বেশি পরীক্ষা নিতে পারছি না। আগে ক্লাস পরীক্ষা নিতাম। এখন তা-ও পারছি না। ফলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষায় দেখা যায় জিপিএ-৫ কিংবা জিপিএ ৪-এর সংখ্যা একেবারে কম। তার মানে হলো- পড়ালেখার মান বাড়ছে না। পাসের হার বাড়ছে ঠিকই। এমন পাস করে ছাত্রছাত্রীরা বেশি দূর এগোতে পারবে না। অন্যদিকে কোচিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও শহরে দিব্যি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে কোচিং ব্যবসা চলছে সমানে। নতুন নতুন পদ্ধতিতে কোচিং সেন্টারে হচ্ছে লেখাপড়া। অভিভাবকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন কোচিং সেন্টারগুলোতে। বিপরীতে গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেটও পড়তে পারছে না নিজের স্কুলের শিক্ষকদের কাছে। মন্ত্রণালয়ের বাধার কারণে শিক্ষকরা ভয়ে কাউকে পড়াতে চাইছেন না। এ অবস্থায় শহর আর গ্রামে শিক্ষার বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। শিগগিরই এদিকে নজর দিতে হবে। নইলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।

No comments

Powered by Blogger.