রিগ্যান থেকে রাষ্ট্রদূত by সৈয়দ আবুল মকসুদ

বাঙালির শত শত বছরের আইন-আদালত ও মামলা-মোকদ্দমার ইতিহাসে যিনি ছিলেন সবচেয়ে শক্তিধর আসামি, তাঁর নাম রোনাল্ড রিগ্যান। তাঁর প্রিয়তমা পত্নী ন্যান্সি তাঁকে আদর করে ডাকতেন রন। রিগ্যানের জীবনে সংকট দেখা দিয়েছিল দুবার। একবার ১৯৮১-তে যখন তিনি হিলটন হোটেলের সামনে আততায়ীর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েও ঈশ্বর ও ডাক্তারদের কৃপায় বেঁচে যান। তাঁর জীবনের দ্বিতীয় বিপদ দেখা দেয় এক দেওয়ানি মামলার আসামি হিসেবে যখন ঢাকার তৃতীয় মুন্সেফ কোর্টের সমন জারি হয় তাঁকে সশরীরে আদালতে হাজিরা দিতে। আমেরিকার ৪০তম প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের আদালত সমন জারি করেন। কাজ-কাম ফেলে ঢাকা জেলা জজকোর্টে হাজিরা দেওয়া তাঁর জন্য বেশ ঝামেলার ব্যাপারই ছিল।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস নির্মাণের জন্য জমি দরকার। সোভিয়েত ইউনিয়ন না ভাঙলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দুনিয়ার এক নম্বর সুপারপাওয়ার। তাদের দূতাবাসের জন্য একটি জুতসই জায়গা চাই। আমাদের সামরিক সরকার একটি ফাঁকা জায়গা পেল তৎকালীন শেরাটন হোটেলের পশ্চিম দিকে পিজি হাসপাতালের পেছনে। জায়গাটি ছিল ঢাকার নবাবদের। মার্কিন দূতাবাসের জন্য সরকার সেটা বরাদ্দ করে।
ঢাকার খাজা পরিবারের ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডে’র কেউ একজন সোজা চলে যান জজকোর্টে। সেখানে তৃতীয় মুন্সেফের আদালতে ওই জমি বরাদ্দের বিরুদ্ধে এক মামলা ঠুকে দেন। তার এক নম্বর আসামি মি. রোনাল্ড রিগ্যান। পিতা মৃত অমুক। সাকিন হোয়াইট হাউস। ওয়াশিংটন ডিসি। অভিনয় ছেড়ে দিয়ে বর্তমান পেশা রাজনীতি। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
মামলায় মুন্সেফের নির্দেশে পেশকার সমন জারি করেন। সমন নিয়ে আটলান্টিকের ওপারে বিমান ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয় বলে সাইকেলে চড়ে পেয়াদা ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে যান। খবর পেয়ে দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা গেটের কাছে এসে পেয়াদাকে বলেন, যাঁর বিরুদ্ধে সমন হয়েছে তিনি এখানে থাকেন না। থাকেন ওয়াশিংটনে। সেখানেই সমন পাঠিয়ে দিন। সমন পেলে তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন যে ঢাকার তৃতীয় মুন্সেফের কোর্টে এসে হাজিরা দেবেন, নাকি দেবেন না। না এলে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন।
পেয়াদা ফিরে আসার পর ব্যাপারটা আর বেশি দূর গড়ায়নি। কাগজে খবর বেরোনোর পরই সরকার বলে, কম্ম কাবার। আসামিকে প্রটোকল ও নিরাপত্তা দেওয়ার সাধ্য বাংলাদেশ সরকারের নেই। তাড়াতাড়ি সরকার মার্কিন দূতাবাসের জন্য বারিধারায় জমি বরাদ্দ দেয়।
উল্লেখযোগ্য যে নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের সরকার ওই জমিটি তাদের একজন প্রিয় ব্যবসায়ী ও ওষুধ কোম্পানির মালিককে বরাদ্দ দেয়। এবারও তা নিয়ে কোর্ট-কাছারি হয়। আওয়ামী শিল্পপতির সেই মামলায় আইনজীবী ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যারিস্টার, যিনি বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা।
কথায় আছে, কাজ না থাকলে বাঙালি চাচার নামে মামলা দেয়। সম্পাদক-প্রকাশক-রিপোর্টারদের বিরুদ্ধে যখন-তখন মামলা ঠুকতে ঠুকতে বাঙালি এখন যার-তার বিরুদ্ধে মামলা হাঁকাচ্ছে। এবার আসামি বাংলাদেশে নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি ইয়ুন-ইয়াং। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা মামলায় তাঁকে সমন দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে সমনটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা আদালত ১০ সেপ্টেম্বর সকাল নয়টায় লি ইয়ুন-ইয়াংকে হাজির হতে গত ১০ জুলাই নোটিশ দেন।
মান্যবর রাষ্ট্রদূত প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমি আশা করব, ভবিষ্যতে কোনো কূটনীতিককে সমন করার আগে আদালত ভিয়েনা কনভেনশন অনুসরণের মাধ্যমে সতর্কভাবে পদক্ষেপ নেবেন।’ এটা ছিল কূটনীতির ভাষার কথা।
মান্যবর রাষ্ট্রদূত জানেন না যে ভিয়েনা কনভেনশন বস্তুটি কী, তা আমাদের সব বিজ্ঞ বিচারক এবং আইনজীবী জানতে বাধ্য নন। আর সতর্কতা বলে কোনো শব্দ যদি বাঙালির জীবনে থাকবে তাহলে ১২০ বছর আগে স্বভাবকবি গোবিন্দ দাস কেন লিখবেন: ‘বাঙালি মানুষ যদি প্রেত কারে কয়?’
বাস্তবতা হলো, লক্ষ্মণ সেন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কোনো বাঙালিরই রাষ্ট্র চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। এ রাষ্ট্রে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ছাড়া আর কাউকেই জবাবদিহি করতে হয় না তাঁর অকাজ-কুকাজের জন্য। যে মুন্সেফ রিগ্যানকে সমন করেছিলেন, তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়নি। মিস্টার লিকে সমন জারির যে [ফজলে] এলাহি কাণ্ড—এই মাননীয় জজকেও কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। আইন মন্ত্রণালয় যদি তাঁকে কোনো চিঠিপত্র দেয়, তিনি এক কথায় সব শেষ করে দেবেন: তখন আমি শোক দিবসের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, ব্যস।
মিস্টার লি এবং অন্যান্য বিদেশি কূটনীতিক বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা নিয়ে যাঁর যাঁর দেশে ফিরে যাবেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.