সম্প্রচার কমিশনই–বা কী সুরক্ষা দেবে? by বদিউল আলম মজুমদার

৮ আগস্ট সিলেটে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী সাংবাদিকদের অত্যন্ত অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এরা সব খবিশ, চরিত্রহীন! স্বাধীন কমিশন হলে পরে দেখে নেব, তোমরা (সাংবাদিকেরা) কতটুকু যেতে পারো!’ অন্যদিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ১১ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের জন্য নয়, বরং এর প্রতিটি ধারা গণমাধ্যমের জন্য কল্যাণকর ও সম্প্রচারে সহায়ক। তাঁর দাবি, সম্প্রচার নীতিমালায় তথ্য মন্ত্রণালয়কে কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি; বরং মন্ত্রণালয় সম্প্রচার মাধ্যমের ওপর থেকে বিদ্যমান দায়িত্ব গুটিয়ে নিয়ে কমিশনের হাতে সেই দায়িত্ব অর্পণের জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে এই নীতিমালা প্রণয়ন করেছে (প্রথম আলো, ১২ আগস্ট ২০১৪)।

দুজন মন্ত্রী স্বাধীন সম্প্রচার কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে বিপরীতমুখী বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা কাকে বিশ্বাস করব? আমরা কি শঙ্কিত হব, না আশ্বস্ত থাকব? এটা নির্ভর করবে ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। এই সরকার অনেকগুলো কমিশন গঠন করেছে এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহু নিয়োগ দিয়েছে। সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের কি এসব ক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে? কমিশনগুলো কি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আচরণ করেছে এবং জনস্বার্থ সমুন্নত রেখেছে? নাকি ক্ষমতাসীনদের স্বার্থই হাসিল করেছে? এসব প্রশ্নের উত্তরের ওপরই নির্ভর করবে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা।
সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই সন্দিহান এবং তার কারণও আছে। সরকার একটি ভোটারবিহীন জবরদস্তিমূলক তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গত ৫ জানুয়ারি ক্ষমতায় ফিরে আসে। সেই নির্বাচনের আগে তাদের আশ্বাসবাণী শোনা যাচ্ছিল যে নির্বাচনের পর সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে, বছর দুইয়ের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করবে। কিন্তু নির্বাচনের পর তারা তাদের ভোল পাল্টে ফেলেছে এবং পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে। একই সঙ্গে তারা অতীতের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অপশাসন অব্যাহত রেখেছে। তাই জনসমর্থনের দিক থেকে সরকার আরও চাপের মুখে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম এবং এর মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করার দুরভিসন্ধি নিয়েই সরকার সম্প্রচার নীতিমালা করেছে, পরে এর ভিত্তিতে আইন করতে যাচ্ছে।
সম্প্রচার নীতিমালার অপব্যবহার করে সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা হরণ করতে পারবে। কিন্তু এ ধরনের স্বাধীনতার ওপরই গণতন্ত্রের কার্যকারিতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুলাংশে নির্ভরশীল। গত এপ্রিলে মার্কিন ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া অ্যাসিস্ট্যান্স’ কার্যক্রমের উদ্যোগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে গত পাঁচ বছরের বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতার ওপর একটি গবেষণা চালানো হয়। বাংলাদেশসহ ১৭টি দেশের ওপর পরিচালিত গবেষণা থেকে দেখানো হয় যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিকাশের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠারই পূর্বশর্ত। কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমেই গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়।
এবার সরকারের গত পাঁচ বছরে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের অভিজ্ঞতার দিকে নজর দেওয়া যাক। সুপ্রিম কোর্টে ৬০ জনের অধিক বিচারক নিয়োগ দেওয়া ছাড়াও সরকার নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনে অনেকগুলো নিয়োগ দিয়েছে। এসব নিয়োগের অনেকগুলোরই যথার্থতা নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক প্রশ্ন উঠেছে।
নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের বিষয়ে আসা যাক। ড. শামসুল হুদা, ছহুল হোসাইন ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত সম্মান ও যোগ্যতার সঙ্গে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে কমিশনের পুনর্গঠন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মাননীয় রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সংলাপের আয়োজন করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তা ছিল লোক দেখানো ব্যাপার। কারণ সংলাপের পর যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়, তার নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। অনুসন্ধান কমিটির অন্তত একজন সদস্য সম্পর্কে আমরা জানি, যিনি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্যানেলে ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও জুন মাসে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান (নিউ এজ, ২৮ জানুয়ারি ২০১২)। অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে ২০১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের দাবি সত্ত্বেও অনুসন্ধান কমিটি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো রূপ স্বচ্ছতা প্রদর্শন করেনি। কমিটি অন্য কাদেরকে মনোনয়নের জন্য বিবেচনা করেছিল এবং কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে এই পাঁচজনকে মনোনীত করেছিল, তা প্রকাশ করেনি (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ২০১২)।
কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কথা সবারই জানা। এই কমিশনের সহযোগিতার ফলেই বর্তমান ক্ষমতাসীন দল গত ৫ জানুয়ারির কলঙ্কজনক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও সহিংসতার পর নির্বাচন কমিশন তার দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অথচ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যেই স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দুর্ভাগ্যবশত, অন্যান্য কমিশন গঠনের ব্যাপারেও সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন ও তথ্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে ব্যাপক সংশয় রয়েছে। কারণ, এগুলো হয় সরকারের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, না হয় ক্ষমতাসীনেরা অসন্তুষ্ট হবে এমন সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে। তাই সম্প্রচার কমিশন গঠনের মাধ্যমে যে সরকার গণমাধ্যম ও জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ, এ ব্যাপারে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই বললেই চলে। সুতরাং সম্প্রচার কমিশন গঠন গণমাধ্যম ও নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার রক্ষাকবচ নয় এবং সম্প্রচার নীতিমালা–সম্পর্কিত সরকারের উদ্যোগে নাগরিক হিসেবে আমরা সত্যিই শঙ্কিত।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.