পদোন্নতির ভারে নড়বড়ে জনপ্রশাসন by আলী ইমাম মজুমদার

কোনো প্রতিষ্ঠান তার তুলনামূলক কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের স্তরে ক্রমান্বয়ে নিয়ে যায়। সে পদোন্নতি হয় প্রতিষ্ঠানের চাহিদা ও কর্মপরিধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এতে প্রতিষ্ঠানের কাজে বাড়ে গতিশীলতা। পাশাপাশি পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উচ্চতর বেতন, সুযোগ-সুবিধাদি ও মর্যাদা উপভোগ করেন। বৃদ্ধি পায় তাঁদের কর্মপরিধি। এ ধরনের পদোন্নতি কর্মকর্তাদের জন্যও প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এর সুফলও ভোগ করে সে প্রতিষ্ঠানটি। জনপ্রশাসনও এমনই একটি প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে এখানেও এ উদ্দেশ্যেই পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু গত কয়েকটি সরকারের সময়ে এর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি নজরে আসতে থাকে। পরিণতিতে পদোন্নতির সুফল চাপা পড়ে গেছে। বরং এটা ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে ফেলছে জনপ্রশাসনকে। পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে পদ-পদবি সংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বেশি। আবার সে পদোন্নতি বিবেচনায় রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে ব্যতিক্রমহীনভাবে সামনে রাখা হচ্ছে।

নির্বাচনের আগে জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও কোনো সরকারই এ প্রবণতা থেকে পিছু হটছে না। তাই প্রশাসনকাঠামোটি ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়ছে নড়বড়ে। পদোন্নতি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাঠামোকে সমৃদ্ধ করার পরিবর্তে নড়বড়ে আর কর্মকর্তাদের একটি অংশকে হতোদ্যমও করতে পারে। সেটা আমাদের প্রশাসনের হালচাল পর্যালোচনা করলে সহজেই বুঝতে পারা যায়।

সব দেশেই যেকোনো ধরনের সরকারব্যবস্থায় একটি বেসামরিক প্রশাসনিক কাঠামো থাকে। সে কাঠামোটি যত মজবুত আর কার্যকর হয়, তত বেশি দক্ষ হয় সে সরকার। সুফল ভোগ করে জনগণ। আর তা করতে প্রয়োজন নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদায়ন ও পদোন্নতিকালে মেধা ও উপযুক্ততার যথার্থ মূল্যায়ন। তদুপরি আবশ্যক উপযুক্ত বেতনকাঠামো। আরও প্রয়োজন আইনানুগ দায়িত্ব সম্পাদনে তাদের ওপর অকারণ হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। দুর্ভাগ্যবশত আমরা কয়েক যুগ ধরে এর কোনোটিই যথার্থভাবে করতে পারছি না। এখানে রয়েছে নিয়োগে কোটার বিবেচনাহীন বৈষম্যমূলক অনুপাত। ফলে সূচনাতেই মেধাবীদের একটি অংশ হয় নির্বাসিত। নেই উপযুক্ত প্রশিক্ষণব্যবস্থা। বেতন-ভাতাদিও অপ্রতুল। পদায়ন ও পদোন্নতিতে চলছে যথেচ্ছ দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি।

আইনানুগ দায়িত্ব সম্পাদনে সব স্তরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এখন অনেকটা প্রশাসনিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। কয়েকবার সরকার পরিবর্তনেও এসব বিষয়ে ইতিবাচক কোনো ধারা চালু হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রশাসন-যন্ত্রটির কার্যকারিতা ক্রমহ্রাসমান। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকারের দক্ষতায়। এ অভিযোগ দেশি-বিদেশি সব মহলে। এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘকাল অনেক লেখালেখি, সভা-সেমিনার হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার ক্রমাবনতি মোটেই থেমে নেই।

এ অবনতিশীল অবস্থার জন্য বেশ কিছুকাল ধরে পদোন্নতির যে সংস্কৃতি চলছে, তা অনেকাংশে দায়ী। পর্যালোচনা করা আবশ্যক এসব পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নতুন কর্মপরিধি আর বঞ্চিত ব্যক্তিদের অবস্থান নিয়ে। পদোন্নতি দেওয়ার জন্য এখন প্রাতিষ্ঠানিক চাহিদা অনেকটাই সংগতিহীন। নচেৎ বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের এক হাজার ৩৬৭ নিয়মিত পদের বিপরীতে দুই হাজার ৪৮৭ জন নিয়োজিত থাকতেন না। অর্থাৎ চাহিদার দ্বিগুণ কর্মকর্তা রয়েছেন এ তিনটি স্তরে। আরও পদোন্নতি প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন। আশা করা যায়, শিগগির বেশ কিছু হবে। মধ্যম ও সিনিয়র স্তরের এ তিনটি পদে দ্বিগুণ সংখ্যক কর্মকর্তা থাকলেও ভিত্তিস্তরে (সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব) কিন্তু শূন্য রয়েছে প্রায় অর্ধেক পদ। স্বাভাবিক নিয়মে কোনো সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামো হওয়ার কথা পিরামিড আকৃতির। তবে এখন হয়ে পড়েছে হালকা ভিতের ওপর স্থূলকায় একটি কাঠামো। ফলে নড়বড়ে হওয়ারই কথা।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়: অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের নিয়মিত ১০৭, ৪৩০ আর ৮৩০টি পদের বিপরীতে ‘কর্মরত’ রয়েছেন যথাক্রমে ২৭৩, ৯১৯ আর এক হাজার ২৯৪ জন কর্মকর্তা। তাঁদের ভারে সচিবালয় এমনকি কোনো দপ্তর-অধিদপ্তর বা সংস্থাও আজ ভারাক্রান্ত। তাঁদের বেশির ভাগই এক ধাপ নিচে কাজ করেন। অনেকেই প্রাধিকার অনুযায়ী পাননি অফিস, সহায়ক কর্মচারী আর গাড়ি।

সংবিধানের নির্দেশনা অনুসারে রাষ্ট্রপতি প্রণীত রুলস অব বিজনেসে সরকার পরিচালনার বিধানাবলি সন্নিবেশিত আছে। এতে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকেন মন্ত্রীর পরেই সচিব। এর পরের স্তরের নাম অনুবিভাগ। অনুবিভাগের প্রধান হবেন অতিরিক্ত সচিব কিংবা যুগ্ম সচিব। এর নিচের স্তর অধিশাখার প্রধান হবেন উপসচিব। অর্থাৎ যুগ্ম সচিবেরা অতিরিক্ত সচিবের অধীনে নন। অথচ এখন প্রায় সব মন্ত্রণালয়-বিভাগে যুগ্ম সচিবেরা নথি পেশ করছেন অতিরিক্ত সচিবের মাধ্যমে। এটা রুলস অব বিজনেসের সরাসরি ব্যত্যয় আর অযাচিত কালক্ষেপণ। প্রকৃতপক্ষে, যুগ্ম সচিবদের অনেকেই উপসচিবদের অধিশাখা দখল করে বসে আছেন। উপসচিব সামাল দিচ্ছেন শাখা। এতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কর্মপরিধি বেড়েছে, এমনটা বলা যাবে না। তাই তাঁদের মাঝে পদোন্নতির তৃপ্তি পরিপূর্ণ হওয়ার কথা নয়।

পদোন্নতি দেওয়ার সময় কারও রাজনৈতিক আনুগত্য ‘যাচাই’ আর প্রতিকূল মনে হলে তাঁকে বঞ্চিত করা আজ অন্তত দুই দশকের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সে ‘যাচাই প্রক্রিয়াও’ অনেক ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও যথার্থ নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কর্মকর্তাদেরই একটি অংশ প্রতিটি সরকারের সময়ে ‘আমাদের লোক’ হয়ে যায়। তারাই তালিকা বানায় ‘ওদের লোকদের’। ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাদ পড়ে যান নিছক ছাপোষা কর্মকর্তারা। বিশেষ করে নিরপেক্ষ ও অনমনীয় চরিত্রের অধিকারী বেশ কিছু কর্মকর্তা সব সরকারের সময়েই চিহ্নিত হচ্ছেন ‘ওদের লোক’ বলে। ফলে ওঁরা আজ জনপ্রশাসনে বিপন্ন প্রজাতি হতে চলছেন। অধিকতর দক্ষ, মেধাবী ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে তুলনামূলকভাবে সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বেশ কিছু কর্মকর্তা পদোন্নতির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।

এটা মেনে নিতে হবে যে, চাকরিতে সবাই পদোন্নতি পাবেন না। ওপরের দিকে ক্রমান্বয়ে পদ কমতে থাকে। তাই প্রতি স্তরেই বেশ কিছু বাদ পড়ে যাবেন। এ বাছাই–প্রক্রিয়াটি যদি স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ঠ হয়, তাহলে বাদ পড়ে যাওয়া কর্মকর্তারা ব্যথিত হলেও কারও কিছু করার নেই। তাঁদের বঞ্চিতও বলা যাবে না। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঠিক এমনটি ঘটছে না, এ অভিযোগ অতিশয়োক্তি নয়।

মেধাবী, দক্ষ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদোন্নতিবঞ্চনা আর ক্ষেত্রবিশেষে ওএসডি করার ঘটনা এখন আর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার আবশ্যকতা নেই। অথচ এসব বঞ্চিত কর্মকর্তার মধ্যে বেশ কিছু অধিকতর যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। সমৃদ্ধ হতো সরকারের কার্যাবলি।

এ ধরনের পদোন্নতিতে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড। যুগবাহিত ঐতিহ্যে আজ ধস নেমেছে। অকারণে পদোন্নতিবঞ্চিত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাজ করতে হচ্ছে কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অধীনে। ক্ষেত্রবিশেষে অধীন কর্মকর্তারা মেধা ও মননে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চেয়ে উঁচু মানের।

একই মন্ত্রণালয়ে একই ব্যাচের উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব কাজ করছেন। পদোন্নতি–প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও নৈর্ব্যক্তিক হলে এ বিষয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন থাকত না। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে তা নয় বলে এ ধরনের অধীনস্থদের কাছে উপরস্থ কর্মকর্তারা সহজাত আনুগত্য আশা করতে পারেন না। পেতে পারেন নিছক আইনি আনুগত্য। মাঠ প্রশাসনেও কিছু ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে বলে জানা যায়। ফলে কাজকর্মে বেশ কিছু ক্ষেত্রে একটি নীরব অনীহা বিঘ্নিত করছে গতিশীলতা। অদক্ষতাও চেপে বসেছে স্তরে স্তরে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ সংস্কৃতিতে এমনটাই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাজনীতি এখনো শক্ত ভিত নিতে পারেনি। বরং পারস্পরিক বৈরিতায় আজ প্রধান দুটি দলের মুখ-দেখাদেখিও বন্ধ। এ অবস্থায় একটি শক্তিশালী ও দলীয় বৃত্তের বাইরে থাকা জনপ্রশাসন যেকোনো অবস্থায় যেকোনো সরকারকে সেবা দিতে পারে। বিপন্ন এ প্রতিষ্ঠানটি বহুতর সমস্যার মধ্য দিয়ে চলছে। সরকার চাইলেই এর বেশ কিছু সমাধান সম্ভব। তার মধ্যে রয়েছে পদোন্নতিজনিত বর্তমান অবস্থা পরিহার, যা হওয়ার হয়ে গেছে৷ নির্দিষ্ট পদসংখ্যায় পদোন্নতি সীমিত রেখে নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিবেচনায় পদোন্নতি দেওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি আবারও কিছুটা গতিশীল হবে। শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এ কামনা সবার। তবে আশঙ্কা থেকে যায়—হবে কি?

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.