অ-ফেরা by জয়া ফারহানা

সম্পূর্ণ রায়গঞ্জটাই যেন পৌষের নিস্তরঙ্গ জলে থির দাঁড়িয়ে থাকা একখানা পানসি নৌকো। এক দৌড়ে বুড়ি ছোঁয়ার মতো অন্তরঙ্গ ছোট্ট একটা শহর। গোটা শহরটাই হবে বোধহয়, কত- ১০-১৫ কিমি.। তার বাইরে জঙ্গল আর জঙ্গল। কোথাও কোথাও জঙ্গল এত ঘন যে মধুকূপী ঘাসগুলো পর্যন্ত গলা ডুবিয়ে দেয়। মহানন্দা বলে একটি পাহাড়ি নদী সেখানে পাথরের ছোট বড় টিলার ওপর দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে চলেছে। বর্ষাকালে জল সেখানে ভারী গভীর, শীতকালে জল নেমে আসে হাঁটুতে। সারাদিনের অখণ্ড নির্জনতায় সামান্য ছেদ পড়ে সন্ধ্যায়। দুদিকের টানা বারান্দা দেয়া প্রাচীন আমলের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর তুলসী মঞ্চ থেকে ভেসে আসে শাঁখের পোঁ পোঁ- তখন ঘুলঘুলিতে পায়রারাও সেই সুরে সুর মেলায়। আর আছে দু’একটা সখের বাইসাইকেল টুংটাং-টুংটাং। লাল ছইওয়ালা ২-৩ খানা রিকশা- ক্রিং ক্রিং। সীমান্ত এলাকা বলে অবশ্য বন্দরের একেবারে শেষ মাথায় ৯ মাসের পোয়াতি পেটের মতো পেট উঁচু ট্রাকগুলো ভারী ভারী মাল নিয়ে বন্দরমুখে ছুটে যায় শাঁ-শাঁ। আছে চীনের তৈরি কয়েকটি ইজিবাইক। কৃষি কাজে ব্যবহার হওয়া নসিমন-করিমন ও যারা বিপদের মুখে রায়গঞ্জে সদরে পৌঁছে দেয় জনপ্রতি তিন-চার টাকায়। শহরের একদম মাঝখান দিয়ে চলে গেছে লাল খোয়া ভাঙা ইটের রাস্তা। এখনও পুরোপুরি পাকা নয়। তার ঠিক পাশেই জল দুয়ানি খাল। সেই খালের ওপর বাঁশের আঁড়ে বসে থাকে দু’একটা মাছখেকো মিশকালো পানকৌড়ি আর ভোঁদর। আর সেই খালের গাঘেঁষে কাকডাকা ভোর আর বাদুড় ওড়া সন্ধ্যায় যুবতী মেয়েরা গান ধরে- ‘সতী কন্যা বিবাহ করাইল- যে কারণে।’ শহর থেকে খানিকটা দূরেই গজার জঙ্গল। এমনিই গজার যে সেখানে বিঘাখানেক জমি আবাদের উপযুক্ত করতে, বুনো মোষ আর শুয়োর চরিয়ে বেড়াতে টানা দেড়-দুমাস মেহনত করতে হয়। লোকে তো বলে এক ধরনের ‘ডামাবানু’ নামের জিন-পরী থাকে ওই ‘হলোধরার’ জঙ্গলে। আবার এমন দুর্নামও আছে মানুষকে বেঘোরে পেলে তারা মেরেও ফেলে। আছে ভয়ানক সব জোড়া জোড়া শঙ্খচূড় সাপ। যাদের ভয়ে কাঠুরিয়ারা পর্যন্ত মূল জঙ্গলে কাঠ কাটতে সাহস পায় না। সদ্য এসেছেন এখানে হাসনাত সাহেব তাঁর উপন্যাসটি লেখার জন্য। বহুদিন ধরে মগজের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে চরিত্রগুলো, প্লট। বলা যায় পোকার মতো সারাক্ষণ তার নাকের মধ্যে বো-বো ঘুরছে। ৬ মাসের মতো হল তার রাইটার্স ব্লক চলছে। সেই ভয়ঙ্কর দুর্দশা থেকে বাঁচতেও ছুটে এসেছেন তিনি এখানে। মানে এই জঙ্গুলে শহর রায়গঞ্জে। এখানকার ডাকবাংলোর খোলা বারান্দায় ক্যাম্প খাটে শুয়ে থাকলে বুনো মোষের ডাক শোনা যায়। বাতাসে লেপ্টে থাকে বহেরা ফুলের গন্ধ। দেখা যায় বহু দূর পর্যন্ত ফাঁকা আকাশ আর পাকুড় গাছের ডালে, মানে মগডালগুলোতে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে বক বসে থাকে সবুজ পাতার ফাঁকের মধ্যে মনে হয় যে হলুদ সাদা দুধিয়া ফুল ফুটেছে। এসব দেখতে দেখতেই হাসনাত ভাবেন যখন তার লেখা শেষ হবে ফিরে যাবেন জাদু বাস্তবতার শহর ঢাকায় তখন সত্যি সত্যিই এসব দুর্লভ বুনো দৃশ্যের আলাদা কোনো তাৎপর্য থাকবে কিনা। মানস-সরোবরের জঙ্গল নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, তারও আগে পূণিয়ার জঙ্গল নিয়ে বিভূতিভূষণ লিখেছেন অসামান্য ক্ল্যাসিক... তার লেখা আর বাংলা সাহিত্যে নতুন কী মাত্রা যোগ করবে। তাছাড়া রায়গঞ্জের জঙ্গল এখনও তেমন ঘুরে দেখা হয়নি তার। ক’দিন মাত্র এসেছেন। একদিনই মাত্র গিয়েছিলেন এর মধ্যে মহানন্দার পাড়ে। তাছাড়া পাড় মফস্বল হলে কী হবে, এখানকার স্থানীয় মানুষদেরও তো মনে হল ঢাকার লোকদের মতো আইসোলেটেডই। হাইওয়ের পাশে ঝুপড়ি চায়ের দোকানে বসে হাসনাত কারও কারও সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা চালিয়েছেন বৈকি। কিন্তু আলাপ জমে ক্ষীর হয়নি, ফেটে ফেটে গেছে। তাছাড়া এলাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য সামাজিক জীবন ভালো, মন্দ, ভাষার বুৎপত্তি এসব নিয়ে কথা বলবেন-ই বা কার সঙ্গে। আছে কে? ছোট্ট মফস্বল শহর। তাও আবার জঙ্গলের পাশে। সহজে কী কেউ নাগরিক সুবিধা ছেড়ে আসতে চায়। তারপরও ঝুপড়ি দোকানের ছত্রাক পড়া টেস্টে বিস্কুট মুখে দিয়ে দোকানির সাথে আলাপ জমাতে চেয়েছিলেন। তা সেদিন চায়ে দোকানি মানে আলতাফ এমন চিনি মেশালো যে হাসনাতের কথা বলার আগ্রহ-ই উবে গেল। হাসনাত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চাশটি বছর কাটিয়েছেন ঢাকায়। চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফিতে অভ্যস্ত হয়েছেন ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পরপরই। তাও প্রায় এক যুগের ওপর। প্রায় সুইটেক্স গোলানো সেই শরবতে চুমুক দিয়ে তিনি সান্ত্বনা পেতে চাইলেন এই ভেবে যে, যাক, অন্তত এ সামাজিক পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্তে আসা গেল যে মফস্বলের মানুষ চায়ে অতিরিক্ত মিষ্টি খায়। ঠিক তার পরপরই মুখভর্তি দাড়ি গোঁফওয়ালা একজন এসে বলল আলতাফ চা দে তো চিনি ছাড়া। হাসনাত ঔৎসুক্যের সাথে জানতে চাইলেন ভাই কি ডায়বেটিসের পেসেন্ট? দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোকটি সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, কেন বলুন তো। অতএব হাসনাত তার পর্যবেক্ষণ শক্তি ভালো বলে যে মনে মনে একটি গোপন গর্ব নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তাতেও জল পড়ল।
ভদ্রলোক অবশ্য পড়ে বেশ আন্তরিক স্বরেই বললেন- ডায়াবেটিস ফেটিস নয়- কাজের প্রয়োজনে নানান শহরে ঘুরে বেড়াতে হয়... চিনির অনুপাত একবার ফিক্সড হয়ে গেলে, বারোয়ারী চায়ে স্বাদ পাওয়া যায় না তাই চিনিটাই ছেড়েছেন। পরের প্রশ্নের উত্তরে হাসনাত আবার বড় ধরনের হোঁচট খেলেন। প্রশ্নটা ছিল ভাই সাহেবের কাজটা কী। ভাই সাহেব, ভাই, এ সম্বোধনগুলো অচেনা জায়গায় তাকে বাড়তি সুবিধা এনে দেবে, লোকজন খানিকটা ঘনিষ্ঠতা অনুভব করবে বলে এসব পাতলা খাতির জমানোর চেষ্টা কিংবা খাতির জমানো। দাড়ি-গোঁফ আবারও রহস্য তৈরি করল। ‘তেমন কিছুই না’- বলে সে মুহূর্ত দেরি না করে সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা ধরল। হাসনাত ভাবলেন, দিনকাল বহুত বদলে গেছে। ঢাকার পায়রার খোঁপের মধ্যে বসে বসে, বাইরের মফস্বলকে তারা যত আটপৌরে আন্তরিক, সরল ভাবেন মফস্বল শহরগুলো মোটেই আর তেমন নেই। ভ্রমণের তৃতীয় দিনে অবশ্য হাসনাতের লেখক সত্তার খানিকটা তৃপ্ত হওয়ার কথা। কারণ বাংলোর কেয়ারটেকারের দশ বছরের ছেলেটা ক্লান্ত এবং প্রায় উত্তেজনাহীন স্বরে কেটে কেটে যা বলল, তার- স্থানীয় ভাষায়, সেটাকে, প্রমিতকরণ করলে মানেটা দাঁড়ায় এই যে মহানন্দায় আবারও লাশ ভেসে উঠেছে।
আবার মানে কী? তবে কি মহানন্দায় প্রায় প্রায় অথবা মাঝে মধ্যেই লাশ পাওয়া যায়? আর একেবারে নিরীহ অর্থ করলেও মানে দাঁড়ায় এই যে এবারই অন্তত প্রথম নয়। নিদেনপক্ষে এর আগে অন্তত একটি লাশ পাওয়া গেছে মহানন্দায়। সেদিন-ই হাসনাত ডাকবাংলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে চিতলমারীগঞ্জ পর্যন্ত হাঁটলেন। লক্ষ্য করলেন এই নিয়ে কারও মধ্যে চাপা পিসফিসানিও নেই। স্থানীয় ইজিবাইকের যে ভাড়া তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বাইকওয়ালার কাছে শুনলেন হ্যাঁ, মহানন্দায় মাঝে মাঝেই লাশ পাওয়া যায় বটে তবে সেসব ডামা-বানু জিনের কাজ। হাসনাত তাজ্জবে হাঁ বনে গেলেন। ডামা-বানু জিনের কথা বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন আরণ্যকে। তো শত বছর পরে মধ্য প্রদেশের সেই প্রত্যন্ত ‘কড়ারী তিন টাঙা’ থেকে ডামা-বানু জিন-পরী কী করে মহানন্দায় এসে লাশ ফেলে যাবে সে রহস্যও রহস্যই থেকে গেল হাসনাতের কাছে। ডাকবাংলোর ডাইনিংয়ে বন মোরগের রান চিবুতে চিবুতে তার মনে হল জীবনের গতি যেখানে অতীব মন্থর সেখানকার মানুষ এসব রহস্য টহস্য করতে খুব ভালোবাসে। অথবা এসব তাদের অলস মুহূর্তে জমা হওয়া গল্প গাঁছার দুর্লভ মণি মুক্তো কিংবা কে জানে এসব রহস্যের আড়ালে থাকতেও পারে কোনো বিষধর রাজনীতি। কিছুই অসম্ভব নয়। তারপর মহিষের খাঁটি দুধের চিনিপাতা দই খেতে খেতে হাসনাত ভাবলেন কী জানি বাপু প্রকৃতিবিষয়ক উপন্যাস লিখতে গিয়ে আবার না তাকে ফেলুদার মতো নাক শুঁকতে শুঁকতে রহস্য... নাহ্। ভালো লাগছে না। ঘোর প্যাঁচের দুনিয়া ছেড়ে এসেছিলেন খানিকটা পাহাড়ি হাওয়ার সতেজ বাতাস বুড়ো ফুসফুসে ভরে নিতে। বদলে ফুসফুস দেখি নিকোটিনের চেয়েও বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরে উঠল। কোথায় ভেবেছিলেন, পাহাড়ের টিলায় বসে সূর্যাস্ত দেখবেন, পাহাড়ি ফুলের বুনো গন্ধে মনের আয়ু বাড়িয়ে নেবেন, ঝাঁক ঝাঁক বন্যপাখির নির্ভার ওড়াওড়ি দেখবেন তা না কী সব লাশ টাশ!!! বিভূতিরা ভাগ্যবান ছিলেন বটে। কলকাতা পেরোলেই কলম উজাতো। আর আজকাল ঢাকা কী আর মফস্বল কী সব জায়গা-ই কে, কার বুকে চাকু মারবে সেই সব ওস্তাদি। চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে আজও দেখা হয়ে গেল সেই দাড়ি-গোঁফের সাথে। আজ তার চোখ দুটো আগুনের ভাটার মতো জ্বলছে। একবার কেতলীর ফুটন্ত পানির দিকে চেয়ে আরেকবার সেই কোড়া পাখির চোখের মতো লাল চোখওয়ালা রহস্যময় মানুষটার দিকে চেয়ে হাসনাত বললেন, ‘শুনেছেন নাকি মহানন্দায় লাশ পড়েছে?’
আলতাফ তখন কী একটা জনপ্রিয় বাংলা সিনেমার গানের সুর ভাজছিল। হঠাৎই সেই সুর- ও হ্যাঁ, আমি জ্ঞান হারাব... জাতীয় একটা গান গুনগুন করছিল আলতাফ। তারপর মরেই যাবো, বাঁচাতে পারবে না তো- এই পর্যন্ত গেয়ে সে থেমে গেল- ‘তারপর স্যার তো’- বলেই জিভ কাটল। আর হাসনাত প্রায় একই সঙ্গে দুজনের দিকে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে বলল ‘ও আপনি মাস্টার নাকি?’ আর দাড়ি-গোঁফ, ইটের ভাটার চোখ উত্তর করল না, নাতো। কিন্তু মনে মনে ভাবল লোকটা অতি বোকা নয়তো অতি বদমাশ। এভাবে গায়ে পড়ে কেউ ভাব জমাতে আসে...? হাসনাত তবুও লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলল ‘আর বলেন কেন, সরকার তো বলেই খালাস যে চিন্তার কিছু নেই। এদিকে ছেলে পেলে নিয়ে দুর্ভাবনায় আমাদের নাভিশ্বাস...। ঘরের সব মানুষ ঘরে না ফেরা পর্যন্ত স্বস্তি নেই অথচ... সরকার কিনা...। দাড়ি-গোঁফ আবারও হাঁটা ধরল। হাসনাত লক্ষ্য করল লোকটা একটু পা টেনে হাঁটে। তবে এবার আর সে ভুল করল না। বরং বুদ্ধিমান আর সতর্ক দোকানি আলতাফকে একা পেয়ে মনের প্রশ্নটা করেই ফেলল- ‘লোকটা করে কী?’। দেখা গেল আলতাফকে সে যত চতুর আর কৌশলী ভেবেছিল মোটেই সে তা না। বরং সে কথা বাজ। এতক্ষণ সে কথা বলেনি তা কেবল ইটভাটার মতো লাল চোখের লোকটার জন্য। তবে যা শোনা গেল তাতে হাসনাত আবার খেই হারালো। লোকটা ক্ষেতমজুরদের রাতের বেলা পড়াশোনা করায় আবার অসুখ হলে ওষুধপত্র দেয়... আবার এলাকায় মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার কারণে পাটাও হারাতে বসেছিল। এইসব ছেঁড়া ছেঁড়া তথ্যে তাকে চে’গুয়েভারা ভিন্ন আর কীই বা ভাবা যায়। কেননা আলতাফের ভাষায় ‘হেয় ডাক্তর ও মাস্টরও আবার পোলটিকশও করে।’ নাহ, মাথাটা ভার ভার লাগছে। আর এই সব জবরদস্ত রহস্যের ভার থেকে মাথাকে নিষ্কৃতি দিতে সে রায়গঞ্জ থেকে ১০ কিমি. পশ্চিমে মুণ্ডা পাড়ায় বেরিয়ে আসার চিন্তা করল। মহানন্দা কিংবা মহানন্দার লাশ কিংবা মহানন্দা তীরের বিপ্লবী চেগুয়েভারার মতো পাহাড়ি পথও হাসনাতের কাছে কম রহস্যময় মনে হলো না। পাহাড়ে ওঠার পর সে পথকে মনে হয় খাড়া উত্তরে চলে গেছে দু’কদম যেতে না যেতেই ঠাহর হয়, নাহ্ পথ গেছে পশ্চিমে। বহু পথ উজিয়ে বহু শ্রম ঘাম ব্যয় করে আবিষ্কৃত মুণ্ডাপাড়ায় হাসনাতের অর্জন কিছু কম হল না। কিছু জিনিস, যা সে ভেবেছিল মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বোধহয় তার আর দেখা হবে না, দেখা হয়ে গেল সেসবের সঙ্গে। দুর্লভ সেসব জিনিসের মধ্যে আছে সিঁদুরের চিহ্ন আঁকানো এয়োতি পিঁড়ি, রাধা-কৃষ্ণের ছবি আঁকানো মাটির দেয়াল, কুলুদিতে ঝুলানো লক্ষ্মীর কড়ির চুপড়ি, পিতলের ঘয়লা, কাঁসার গুড়গুড়ি, বাজবৌরী চিল, নিম ফুলের বুনো গন্ধ লাল সবুজের জল ছাপ দেয়া টিনের তোরঙ্গ, নলখাগড়ার বাঁশি, আলকাতরা মাখানো খুঁটি, নিরাম্বড় অথচ আন্তরিক আতিথেয়তা- আর এসব যখন সে ডায়েরিতে লিখছিল তখন এটা লিখতেও ভুলল না যে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, মুণ্ডা, কোল মারমাসহ যাবতীয় আদিবাসীরা ঢাকার লোকদের মতো মনের ভাব গোপন রাখতে শেখেনি। অতএব ধরে নেয়া যেতে পারে মহানন্দার তীরের ছিমছাম রায়গঞ্জ, মুণ্ডাপাড়া আর জঙ্গল হাসনাতের লেখক সত্তাকে একেবারে নিরাশ করেনি। কিন্তু যে কারণে ঢাকা থেকে এই এত দূর রাস্তাঘাটের নানা হ্যাপা পার হয়ে আসা... সেই কাজের-ই তো এখন পর্যন্ত কোন কূল-কিনারা করা গেল না। ঢাকা থেকে তার স্ত্রী, কন্যা, ঘনিষ্ঠ দু’চারজন বন্ধু, প্রকাশক সবাই-ই প্রায় মোবাইলে একই মত দিচ্ছে। হাসনাতের ফেরত আসা উচিত। মহানন্দায় ভেসে ওঠা লাশ কি সবাইকে ভাবিয়ে তুলল নাকি! এমনকি ঢাকাবাসীকেও যারা প্রায় সব ধরনের নৃশংসতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আজ সকালেও বন্ধু সিরাজুল তাকে সতর্ক স্বরে বলেছেন, হাসনাত মহানন্দায় লাশ কিন্তু এখন সচরাচরই মিলছে। শুনে বয়স্ক ঠোঁটের কোণায় ঈষৎ বিদ্রুপের হাসি ঝুলে থাকল হাসনাতের।
আগামীকাল বেডরুমে যে তোমার লাশ পাওয়া যাবে না নিশ্চয়তা কী বন্ধু। হাসনাতের মনে পড়ে ছাত্রাবস্থায় এই সিরাজুলই গরিব এবং পতিতদের দয়া নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বলে ভিক্ষা দিত না এবং এই কাজ করতে গিয়ে তাকে কতবার যে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। যে সময়ের কথা তিনি ভাবছিলেন তখন সিরাজুলদের কৃষক বিদ্রোহ প্রায় নিস্তেজ হয়ে এসেছে। বিদ্রোহের নেতারা একের পর এক ধরা পড়ছেন। সে সময় সিরাজুলও ধরা পড়ল। পাকিস্তান সরকারের পুলিশ, মুসলিম লীগের গুণ্ডারা সিরাজুলদের ওপর হেন অত্যাচার নেই যে করেনি। সিরাজুল অগ্নিশিখার মতো জ্বলন্তই থেকেছে। সেই সিরাজুল আজ তাকে নিয়ে এত পলকা কারণে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। দুনিয়াকে তো সে কিছুই দিয়ে যেতে পারেনি। দুহাত ভরে খালি নিয়েছে আর একটা অর্থহীন জীবনযাপন করে গেছে। এখানে বলে রাখা ভালো আমরা হাসনাতকে বরাবর দেখেছি তার আটপৌরে জীবনের চোখ দিয়ে কিন্তু গল্প কথক জানে যৌবনে লালিত একটি বিপ্লব এবং সেই বিপ্লবের ব্যর্থতাজনিত বিষণœতা হাসনাতকেও সময় অসময়ে গ্লানির ঠোকর দিত। কিন্তু কর্মজীবনের নানান খপ্পরে পড়ে, সংসারের নানান লোভের ফাঁদে তরুণী সুন্দরী স্ত্রীর বিলাসী জীবনযাপনের আকাক্সক্ষার ফাঁদে পড়ে অবশেষে হাসনাত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বিপ্লব বহু দূরের ব্যাপার আপাতত অধিকার বঞ্চিত মানুষদের অধিকার নয়, ভিক্ষার প্রয়োজন। এ মিথ্যে প্রবোধে সে বহুদিন তার ময়ূরের মতো নীল পাখনাওয়ালা পাজেরোর ডানা মেলে পাঁচ টাকা, দশ টাকার নোট ছুড়ে দিয়েছেন- ঢাকার রাস্তায় প্রায় ভিড় জমে গেছে, তারা বলাবলি করেছে নিজেদের মধ্যে আরে এ রুম কুনসুম হয় নিহি? পাজুরুর জানলা কইলাম সবসুমাত বন-ই থাকে। কেলা খুলছে, কেলা? এসব ফিসফিসানি বন্ধ করে এক সময় যার যার কাজের পথে রওয়ানা হয়েছে। গভীর রাতে টিভি ক্যামেরা ছাড়া, হাসনাত, সিরাজুলসহ তার টিভি চ্যানেলের মালিক বন্ধুরা রেলস্টেশনে কম্বল বিলোতে গেছে ঝাকার মধ্যে শুয়ে থাকা আধো-ঘুম, আধো জাগা মানুষগুলো ভেবেছে এইসব কোনো জিন-পরীর কাজ। যেমন হাসনাতরাও বুঝতে পারেনি লুম্পেনস আর কমরেডদের তফাত। দীর্ঘস্থায়ী একটা লড়াইয়ের প্রস্তুতি কি তাদের সবার ছিল? এখন সেই বিপ্লবী ট্রান্সফর্মড-টু লেখক। এই কি পলায়ন? একটা ক্রোধও ক্ষীণভাবে গজরাচ্ছিল হাসনাতের ভেতর। পেছন তাকিয়ে দেখল সেই লাল চোখের লোকটা। আজ থেকে খানিকটা সতেজ দেখাচ্ছে। নিজে থেকে বলল, ‘কী এত সকালে ঘুম ভেঙে গেল।’ দুর্বল একটি হাসি দিয়ে প্রতুত্তর দিতে চাইল হাসনাত। তারপর আরাম কেদারার ক্যানভাসে গা গলিয়ে দিয়ে পাশের দড়ির চার পায়াকে ইঙ্গিত করে বলল, বসুন। এখানে কী মনে করে? আজ ঢাকা থেকে আমাদের সেন্ট্রাল লিডার আসছেন- তার জন্যই রুমের বুকিং দিতে... সিগারেট চলবে? খানিকটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতেই আগুন বদল করল লাল চোখ। আমি অনিরুদ্ধ হাজরা। তত্ত্ব আর শ্রেণী সংগ্রামের যুদ্ধ ছেড়ে এখন মজুরদের সঙ্গে খাঁটি। তাদের সঙ্গেই ওঠা বসা তাদের লেখাপড়া শেখাই। গরিব চাষীদের সংগঠিত করি। জোতদারদের শোষণ বঞ্চনার ইতিহাস শোনাই। হাসনাত সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে বলল ‘হ্যাঁ শুনেছি আপনার সম্পর্কে।’ ‘কী শুনেছেন’? এই যেমন এখানকার লেবার শ্রেণীর মানুষদের কাছে আপনি খুব পপুলার কিন্তু কিছুতেই লিডার বনতে চান না। আবার সব ইউনিয়ন টিউনিয়নই আপনাকে সমঝে চলে। সবার জন্যই আপনার খুব দরদ। ঘরে ঘরে গিয়ে সবার খোঁজখবর করেন। কার অসুখ করল কার ঘরের চালা ভাঙল, কে কোথায় দরখাস্ত লিখবে, কাকে কোথায় ঢোকাতে হবে। অনিরুদ্ধ ঠাট্টা গলায় বলায় ও। কিছু লোকাল মিথ শুনেছেন তাহলে। আমি ভাবলাম আরও কিনা কি। আরও কিছু আছে নাকি? উৎসুক হল হাসনাত। এই যে বাম পা টা দেখছেন, একটু ছোট, শুধু ছোট কেন আমি শুদ্ধ নাই হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আপত্তি না থাকলে বলতে পারেন। না সেসব লম্বা আলাপ। তাছাড়া আজ লিডার আসছেন কাজও মেলা। আসছেন কেন তিনি? উপলক্ষ কি মহানন্দার সুলভ লাশ? কিছু হবে মনে করেন এইসব দায়সারা প্রতিবাদে? কী লাভ এসবে এইসব মৃত্যু, এইসব লাশ তো এখন পাখির পালকের মতোই হালকা। সুযোগ পেয়ে নরম্যান বেথুনকে ঝাড়ল হাসনাত। অনিরুদ্ধর চোখ আবার ইটের ভাটার মতো লাল হয়ে উঠল- আপনার কি ধারণা কেবল পয়সাওয়ালাদের লাশ-ই থাই পাহাড়ের মতো ভারী? হাসনাত বলল, আমার ভাবা না ভাবায় কী যায় আসে চোখের সামনে যা দেখছি তাই-ই বলি আর কী? আমরা তো মৃতদের কাতারে। তবে আপনি কী মনে করেন সেইটে ইমপরট্যান্ট। অনিরুদ্ধর চোখ আরও লাল হয়ে উঠছে। সে কিছুই বলল না। করমর্দনের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো। আর নীরব চোখের চাহনী দিয়ে বুঝিয়ে দিলো, যেন সময় হলেই সে জানিয়ে দেবে কোন মৃত্যুই পাখির পালকের মতো হালকা নয়। সব লাশই থাই পাহাড়ের মতো ভারী।

No comments

Powered by Blogger.