নূহাশপল্লীতে নৈঃশব্দের সন্ধ্যা by মাজহারুল ইসলাম

রাতে ভালো ঘুম হল না। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছি। ভূতবিলাসের বারান্দায় গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়েছে। সে আড্ডার একপর্যায়ে হুমায়ূন আহমেদের অনুরোধে শাওন ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে, জাদুধন’ গানটি গেয়ে শোনান। তারপর থেকেই তীব্র এক হাহাকার আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। গানের সেই বিষণ্ন সুর এখনও আমার কানে বাজছে। অমিয়, অন্বয়, স্বর্ণা ঘুমাচ্ছে। আমি আস্তে করে উঠে জাপানি বটগাছতলায় গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বসলাম। সেখানে আগে থেকেই শাকুর মজিদ বসা। হুমায়ূন আহমেদ ম্যানেজার বুলবুলকে সঙ্গে নিয়ে মাঠের মধ্যে এদিক-ওদিক হাঁটছেন। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও হাফশার্ট তার পরনে। ঘুরে ঘুরে নিজের তৈরি নন্দনকানন দেখছেন। গতকাল ফার্মগেট খামারবাড়ী নার্সারি থেকে বেশকিছু চারা কিনে এনে লাগিয়েছেন। সেগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ম্যানেজারকে কিছু নির্দেশনাও দিলেন। এক সময় খেজুরবাগান ঘুরে এসে দাঁড়ালেন আম্রকাননে। এখানে কিছু সময় ঘুরে দেখলেন। তারপর গেলেন ‘রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যানে’। শতাধিক প্রজাতির ভেষজ গাছ রয়েছে এখানে। উদ্যানের যত্নআত্তির খোঁজখবর নিলেন ম্যানেজারের কাছ থেকে। এবার পুকুরপাড়ের দিকে চলে গেলেন। এরই মধ্যে একের পর এক অনেক টিভি চ্যানেলের গাড়ি নুহাশপল্লীতে ঢুকল। সবাই জেনে গেছে চিকিৎসা বিরতিতে আসা হুমায়ূন আহমেদ আজই নুহাশপল্লী ছেড়ে ঢাকায় চলে যাবেন। নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে এখানে আর আসবেন না। দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররাও এসেছেন অনেকে। শাকুর একজনকে ডেকে মজা করে বলল, ভাই, আপনারা এত সকালে চলে এসেছেন? সাংবাদিক বললেন, শুনেছি স্যার ঢাকা ফিরে যাবেন। তাই সকাল সকাল চলে এলাম।
হুমায়ূন আহমেদ ফিরে এলেন আড্ডার রুমে। তার মা আয়েশা ফয়েজ ও বোন নুহাশপল্লীতে আছেন দু’দিন ধরে। আমরা সবাই একসঙ্গে আড্ডার রুমে বসে নাস্তা করলাম। নাস্তা শেষে আবার তিনি মাঠে বেরিয়ে গেলেন। বের হওয়ার আগে ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন ঢাকা থেকে আসা পত্রিকার লোকজনদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে। সবাইকে যেন খেয়ে যেতে বলা হয়।
এবার সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। বিখ্যাত ফটোসাংবাদিক নাসির আলী মামুন এসেছেন। কাঁধে দুটো ক্যামেরা ঝুলানো। নানাভাবে ছবি তুলছেন। খ্যাতিমান সব মানুষদের পোর্ট্রেটের বিশাল সংগ্রহ তার। অনেক বছর ধরে তিনি হুমায়ূন আহমেদের ছবি তুলছেন। হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের লাগানো বিভিন্ন গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। কোন গাছটা কখন কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন এবং ওই গাছের ঔষধি গুণাগুণ, বৈজ্ঞানিক নাম ইত্যাদি জানাচ্ছেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন দীঘি লীলাবতীর পাড়ে। এখানে একটি স্তম্ভে উৎকীর্ণ আছে দীঘির নামফলক। দু’হাতে স্তম্ভে ভর দিয়ে মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। পাশে তার শিশুপুত্র নিষাদ। এরপর বিশাল এ দীঘির চারপাশটা ঘুরলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। আমি সেই দলের সঙ্গে কিছুক্ষণ হাঁটার পর ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলাম। প্রায় দুই ঘণ্টার মতো হাঁটাহাঁটির পর পদ্মপুকুরের আগের পাড়ে রাখা রট আয়রনের চেয়ারে এসে বসলেন। শুরু হল আবার ইন্টারভিউ দেয়ার পালা। কয়েকটা টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা একসঙ্গে তাকে ফ্রেমবন্দি করেছে এবার। যার যার মতো করে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদ কোনোরকম বিরক্তি ছাড়া একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। সব সময় তাকে দেখেছি সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলতে। কিন্তু এবার চিকিৎসা বিরতিতে আসার পর থেকে দেখছি উল্টোটা। সবার সঙ্গেই কথা বলছেন প্রাণোচ্ছলভাবে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে বন্ধু ও প্রিয়জনরা আসতে শুরু করলেন। ডাক্তার এজাজ ভোরবেলা এসেছেন। সঙ্গে এনেছেন হুমায়ূনের প্রিয় এক বালতি কই মাছ।
বেলা ১১টার দিকে দৈনিক সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার এলেন সস্ত্রীক, সঙ্গে সহকর্মী মাহবুব আজিজ ও তার স্ত্রী। গোলাম সারওয়ারের স্ত্রী হুমায়ূন আহমেদের জন্য অনেক পদের খাবার রান্না করে এনেছেন। এনটিভির অনুষ্ঠানপ্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ এসেছেন। বিটিভিতে থাকাকালীন হুমায়ূন আহমেদের অনেক নাটক নির্মাণ করেছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর সচিত্র সন্ধানীর গাজী শাহাবুদ্দীন এলেন সালেহ চৌধুরীর সঙ্গে। গাজী শাহাবুদ্দীন নিজেও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তারপরও এসেছেন প্রিয় মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে। অসুস্থ অবস্থায় এসেছেন অভিনেতা সালেহ আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য নাটক-সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। গাড়ি থেকে ধরাধরি করে তাকে নামানো হল। হুমায়ূন আহমেদ এগিয়ে গিয়ে বললেন, এ অবস্থায় আপনি কেন এসেছেন?
তিনি বললেন, না এসে কি পারি?
সালেহ আহমেদকে একটি রুমে নিয়ে শোয়ানো হল। শক্তিমান অভিনেতা। বয়স এমন আহামরি কিছু হয়নি। অসুখ-বিসুখের কাছে পরাস্ত।
একপর্যায়ে শিল্প-সাহিত্যের লোকদের মিলনমেলায় পরিণত হলো নুহাশপল্লীর সবুজ চত্বর।
কিছুক্ষণ জাপানি বটগাছতলায় বসে কুশল বিনিময়ের পর হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে নিয়ে তার রুমে চলে এলেন। বাইরে প্রচণ্ড গরম। দরোজা বন্ধ করে ঠাণ্ডা বাতাসে শুরু হল আড্ডা। আড্ডার বিষয়বস্তু মূলত পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ। হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে চিকিৎসা সময়ের মজার কিছু গল্প শোনালেন। ১২টি কেমো শেষ করার পর ডা. জর্জ মিলার যখন জানালেন, ইউ আর নাউ ফিট ফর সার্জারি, সেই সময় তার অনুভূতির কথা। ডাক্তার কী কী বলেছে তার খুঁটিনাটি শোনানোর জন্য স্ত্রী শাওনকে ডাকলেন। তিনি আবার প্রতিটা ঘটনা ডিটেইল বলতে পারেন।
আড্ডার শেষপর্যায়ে গোলাম সারওয়ার জানালেন, তিনি হুমায়ূন দম্পতির সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চান। আমরা একে একে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজা ভেজিয়ে তারা কিছু সময় কথা বললেন। দুপুরের খাবারের জন্য সবাই আড্ডা রুমে। নুহাশপল্লীর পুকুরের তাজা মাছ, সারওয়ার ভাইয়ের আনা খাবার সবমিলিয়ে টেবিলভর্তি বিশাল আয়োজন। মধ্যাহ্নভোজের পর একে একে সবাই বিদায় নিয়ে ঢাকা ফিরে যেতে শুরু করলেন। হুমায়ূন আহমেদ তার রুমে চলে গেলেন বিশ্রাম নিতে। আলমগীর রহমান, শাকুর মজিদ, কমল ও আমি আড্ডার রুমে।
কিছুক্ষণ পর হুমায়ূন আহমেদ ফিরে এলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম কেন তিনি বিশ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। তিনি এসেছেন সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে তার কী কথা হয়েছে তা আমাদের বলার জন্য। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, সারওয়ার ভাই জোর করে আমার পকেটে একটা সাদা খাম ভরে দিয়েছেন। খামের মধ্যে চার হাজার মার্কিন ডলার। তিনি কোনোভাবেই খাম নেবেন না। একপর্যায়ে সারওয়ার ভাই বললেন, আপনার চিকিৎসা-সহায়তার জন্য আমি কিছু দিচ্ছি না। সামান্য কিছু ডলার দিলাম, সার্জারি শেষে আপনি যখন সুস্থ হয়ে উঠবেন, তখন ভাবীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবেন। এ কথার পর তো আমি আর না করতে পারি না।
হমায়ূন আহমেদ একটা পান মুখে দিয়ে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। এর মধ্যে নতুন করে আরও কয়েকজন সাংবাদিক এসেছেন। তাকে জানাতেই তিনি বললেন, বসতে বল, আমি ঘুম থেকে উঠে কথা বলব। ঘুম থেকে উঠে দ্বিতীয় দফা তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সাংবাদিক এবং অন্য যেসব শুভানুধ্যায়ী এসেছিলেন দুপুরের পর, একে একে তারা বিদায় নিলেন। জাপানি বটগাছতলায় আমরা ক’জন একসঙ্গে বসে চা খেলাম। হুমায়ূন আহমেদও আছেন। চা খেয়ে এবার ঢাকা ফিরে যাওয়ার পালা। ম্যানেজার বুলবুলকে বেশকিছু নির্র্দেশনা দিলেন। বাক্সপেটরা গাড়িতে উঠানো হচ্ছে। নুহাশপল্লীর কর্মীরা একে একে তাদের প্রিয় মানুষটির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছে।
আমরা সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি নুহাশপল্লীর মূল ফটকে পৌঁছতেই কর্মীরা দরোজা খুলে দিল। কর্মীদের সবাই এখানে ভিড় করেছে। বিদ্যুতের আলোয় দেখছি সবার মুখেই রাজ্যের বিষণ্নতা। তাদের প্রিয় স্যার সুস্থ হয়ে আবার কবে ফিরে আসবেন প্রিয় নুহাশপল্লীতে? দরোজা পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল শাল-গজারির অরণ্যে ঘেরা ছোট্ট এ জনপদের ভেতর দিয়ে। দুই দশক আগে নিভৃত এ পল্লী জেগে উঠেছিল এক জাদুকরের মোহন মন্ত্রে। অথচ আজ এ সন্ধ্যায় চারপাশটায় গভীর নৈঃশব্দ। খুব দ্রুতই আঁধারে ছেয়ে আসছে এই বনানী। নিকষ আঁধার।

No comments

Powered by Blogger.